ওয়াশিংটন, ইয়াঙ্গুন ও ইউরোপভিত্তিক ডজনের ওপর কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তার কথায় মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ভাবনার কথা উঠে এসেছে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থাটি বলছে, এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস এজন্য আরও কিছু দিন সময় নিতে পারে। রাখাইনে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সহায়তা বাড়ানোরও আলোচনা চলছে।
এক মাস আগেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি আলোচনায় ছিল না জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এতেই প্রমাণিত হয় মিয়ানমারে ঘর-বাড়ি ছেড়ে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের কতোটা চাপে ফেলেছে।
রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে মাসখানেকের মধ্যে সোয়া পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা বলছেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সেনা সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে, ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও নিজেদের অবস্থান থেকে সরেনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এই হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সমালোচনা চললেও অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক দেশটিতে তার নেতৃত্বের বিকল্প দেখছেন না।
পাঁচ দশকের বেশি সময় সেনা শাসনে থাকা মিয়ানমারে গত বছরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সু চির দল এনএলডি সরকার গঠন করলেও এখনও স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আগামী ১৬ অক্টোবর মিয়ানমার নিয়ে আলোচনায় বসবেন। তবে এই বৈঠকেই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ আসবে না বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
নেদারল্যান্ডসের উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী উলা তুয়ারেস রয়টার্সকে বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর আরও চাপ প্রয়োগের জন্য কোপেনহেগেন সংকটটি আলোচ্যসূচিতে আনার চেষ্টা করছে।
মিয়ানমার নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচনা সম্পর্কে অবগত যুক্তরাষ্ট্রের দুইজন কর্মকর্তা বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইংসহ বেশ কয়েকজন জেনারেল এবং রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ থাকা রাখাইন বৌদ্ধ মিলিশিয়াদের নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদ জব্দ, যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ এবং এদের সঙ্গে আমেরিকানদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধসহ অন্যান্য কিছু বিষয় আসতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে ইউরোপ, জাপান ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার কারণে ওয়াশিংটন এ বিষয়ে সাবধানতার সঙ্গে এগোচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তারা।
ইয়াঙ্গুনে নিয়োজিত একজন জ্যেষ্ঠ ইউরোপিয়ান কূটনীতিকও বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এই সংকট মোকাবেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। তারা এ বিষয়ে একমত যে, সমস্যার মূলে সেনাবাহিনী, বিশেষত কমান্ডার ইন চিফ, যে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপে যাকে ‘টার্গেট’ করা দরকার।
ইয়াঙ্গুনভিত্তিক কূটনীতিকরা বলছেন, আলোচনার দ্বার খোলা রাখার জন্য প্রথম পর্যায়ে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রতীকী হতে পারে।
উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, গত বছর ব্রাসেলস, বার্লিন ও ভিয়েনা সফর করা সেনাপ্রধানের পরবর্তীতে ইউরোপ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
১৮ মাস আগে সু চি ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমারের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কে উষ্ণতা দেখা দিলেও চীনের তুলনায় এখনও তা তেমন জোরালো নয় বলে স্বীকার করেন কূটনীতিকরা।
মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের তেমন বিনিয়োগ নেই, সামরিক সংশ্লিষ্টতাও কম।
এছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিলে তা সু চি ও সেনাবাহিনীর সম্পর্কে সমস্যা তৈরি করবে কি না তা নিয়েও তাদের দুশ্চিন্তা রয়েছে।
মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ নিয়ে ব্রাসেলসভিত্তিক একজন ইইউ কূটনীতিক বলেন, অবস্থার উন্নতি না হলে মিয়ানমারের উন্নয়নে কোনো বিনিয়োগ করবে না ইউরোপীয় কমিশন।
“অস্ত্র বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। আমরা নিয়মিত আলোচনা করি, আমাদের কি মিয়ানমারে সংস্কারের পুস্কার দেওয়া উচিত এবং ধীরে ধীরে ওই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা উচিত, নাকি উল্টোটা করা উচিত।”
সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে দেশ শাসন থেকে সরে আসার পর ২০১২ সালে মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ইইউ। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে চলে আসা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এখনও রয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর থেকে বেশিরভাগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রেখেছে।
ওয়াশিংটনে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেন, নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা না থাকলেও নভেম্বরের প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এশিয়া সফর নাগাদ মিয়ানমার নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনায় পৌঁছানোর আশা করছে ওয়াশিংটন।
তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে একটি কড়া বার্তা দিতে চাইছে প্রশাসন। কিন্তু খুব দ্রুত কোনো পদক্ষেপ দেশটির ওপর চীনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব আরও বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেয় কি না তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
তবে আবারও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বৃহৎ পরিসরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে প্রশাসনে তেমন সমর্থন নেই।
রয়টার্সের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে অভ্যন্তরীণ ভাবনা জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেনি হোয়াইট হাউজ।