পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একমাত্র কন্যা দিনা ওয়াদিয়া নিউ ইয়র্কে তাঁর বাড়িতে ৯৮ বছর বয়সে মারা গেছেন। লন্ডনে জন্ম হলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন ভারতের মুম্বাই ও যুক্তরাষ্ট্রে। মাত্র দুবার তিনি পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। অমুসলিম এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পিতার সাথে তার সম্পর্কে চিড় ধরেছিলো।ভারতে বিবিসির সাবেক সংবাদদাতা এন্ড্রু হোয়াইটহেড বহু চেষ্টার পর একবার দিনা ওয়াদিয়ার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন ২০০২ সালে। তাঁর বয়ানে শুনুন দিয়া ওয়াদিয়ার জীবনের কাহিনী:
দিনা ওয়াদিয়া ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একমাত্র সন্তান। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে তাঁর কন্যার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যখন দিনা ওয়াদিয়া তাঁর বাবার মতোই এক অমুসলিমকে বিয়ে করেন।
দিনা প্রবলভাবে প্রচার বিমুখ ছিলেন, মানুষের মনোযোগ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে অনেক চেষ্টার পর ২০০২ সালে আমি নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন এভিনিউতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে সাক্ষাতের সুযোগ পাই।
আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি নাইন ইলেভেনের প্রথম বার্ষিকীর খবর সংগ্রহ করতে। দিনা ওয়াদিয়া জানালেন আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারি।
তিনি এমন একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকেন, যেখানে আপনি অনাহুতভাবে লবি পর্যন্তও যেতে পারবেন না, অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া তো আরও দূরের ব্যাপার।
দিনা ওয়াদিয়া আমাকে জানিয়েছিলেন কোন সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা যাবে না, কোন কথা-বার্তাই 'অন-দ্য-রেকর্ড' নয়। ছবি তোলাও নিষেধ। যদিও আমার অনুরোধে যাওয়ার আগে শেষ পর্যন্ত তিনি তার একটি লাইফ সাইজ পোট্রেটের ছবি আমাকে তুলতে দিয়েছিলেন। তাঁর এই ছবিটি ১৯৪৩ সালে লন্ডনে আঁকা, যখন তিনি সন্তান সম্ভবা, ছেলে ব্যবসায়ী নুসলি ওয়াদিয়া তখন তাঁর পেটে।
দিনা ওয়াদিয়ার মৃত্যুর পর এখন আমি সেই গোপনীয়তার বন্ধন থেকে মুক্ত। যদিও তার সঙ্গে আমার সেই সাক্ষাতে তিনি এমন কিছু বলেননি যা অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই, তারপরও আমি সেই সাক্ষাতের কথা এখন বলতে পারি।
যখন তিনি দরোজা খুলেছিলেন, তখন আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম।একজন ছোটখাট গড়নের কিন্তু খুবই উচ্ছল বৃদ্ধা নারী। ঠোঁটে উজ্জ্বল লাল লিপস্টিক। মুখের গড়ন, নাক, মুখের অভিব্যক্তি, সব মিলিয়ে বাবার সঙ্গে তাঁর চেহারার আশ্চর্য মিল।
আমি এখনো মনে করতে পারি প্রথম দেখায় আমার যে বিস্ময়, তিনি আসলেই বাবার মেয়ে!
দিনা ওয়াদিয়া বেশ প্রাণবন্ত এবং বন্ধুবৎসল। তিনি আমাকে তার সুন্দরী মায়ের একটি ছবিও দেখালেন। রতনবাঈ, একজন পার্সি। যখন দিনার বয়স মাত্র নয়, তখন তিনি মারা যান।দিনা বড় হয়েছেন তার নানীর কাছে।
তার টেবিলে বাবা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি ছবি ছিল। বাবা জিন্নাহর কথা বললেন বেশ গর্বভরে। এটা সত্যি, দিনা যখন একজন পার্সি, নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেন, এটা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। নেভিল ওয়াদিয়া পরে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষা নেন। কিন্তু পরে অবশ্য আবার বাবা-মেয়েতে মিলমিশ হয়েছে। তারা পরস্পরকে চিঠি লিখতেন, কথা বলতেন।
আরও পড়ুন: মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে এক ষোড়শীর অজানা প্রেমকাহিনী
মুসলিম লীগের দাবি অনুযায়ী যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিল ব্রিটিশরা, তখন দিল্লি থেকে মেয়েকে ফোন করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, "আমরা যা চেয়েছে তা পেয়ে গেছি"!
দিনা জানালেন, তিনি ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রে বাবার দিকটাই বেশি পেয়েছেন মায়ের দিকের চেয়ে।
দিনা কখনো পাকিস্তানে গিয়ে থাকেন নি। তিনি আমাকে বললেন, বোম্বে হচ্ছে আমার শহর। যদিও জীবনের একটা বড় অংশ তিনি কাটিয়েছেন লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কে।
১৯৪৮ সালে তিনি পাকিস্তানে গিয়েছিলেন পিতাকে মৃত্যুর পর শেষ বিদায় জানাতে। আরও দুবার পাকিস্তানে গেছেন তাঁর ফুপু ফাতিমাকে দেখতে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের পর থেকে যখন আমাদের এই সাক্ষাৎ হয়, তখন পর্যন্ত তিনি আর পাকিস্তানে যাননি।
বেনজির ভুট্টো এবং অন্য অনেকে বহু বার তাকে পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, বললেন তিনি। কিন্তু তিনি প্রতিবারই এই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি একটা পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হতে চান নি। তিনি অভিযোগ করলেন, পাকিস্তানকে লুন্ঠন করেছে দেশটির নেতারা এবং কোন মুসলিম দেশেই গণতন্ত্র সফল হয়নি বলে সতর্ক করে দিলেন।
তবে আমাদের এই সাক্ষাতের দুবছর পর দিনা ওয়াদিয়া করাচীতে যান এবং তাঁর বাবার সৌধ পরিদর্শন করেন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে অনেক স্মৃতির কথা উল্লে করেন তিনি। গান্ধীর সঙ্গে তার অনেক মধুর স্মৃতি, গান্ধীকে পছন্দ করতেন তার বাবা। সরদার প্যাটেল ছিলেন একেবারে সোজা কথার মানুষ। কিন্তু নেহেরু সম্পর্কে দিনার মন্তব্য, তাকে সহজে তোষামোদ করা যায় এবং নেহেরু আসলে তার পিতার সমকক্ষ নন। আর মাউন্টব্যাটেনকে তিনি বর্ণনা করেন এমন এক মানুষ হিসেবে যাকে বিশ্বাস করা যায় না।
আর নিজের বাবা জিন্নাহ সম্পর্কে দিনা ওয়াদিয়ার মূল্যায়ন? যেভাবে পাকিস্তানে তার বাবাকে পুজা করা হয়, সেটা তিনি পছন্দ করেন না।
এ কথার পর তিনি আমাকে দরোজার কাছে এগিয়ে দেন। কিন্তু এই সাক্ষাতের স্মৃতি এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। নিউ ইয়র্কে আমার হোটেল রুমে ফিরেই আমি তরতাজা এই সাক্ষাতের বিবরণ লিখে রেখেছিলাম।
তার মৃত্যুর খবর শুনে খুব দুঃখ পেলাম। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার স্বাধীনতার যুগের নেতাদের সঙ্গে সর্বশেষ সংযোগ বুঝি ছিন্ন হয়ে গেল। বিবিসি বাংলা