মামলা-মোকদ্দমায় মোটেই ভীত নন বলে আদালতে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে তার আশংকার কারণ অন্য জায়গায় বলে জানিয়েছেন তিনি।
খালেদা জিয়া বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগে দায়ের করা মামলা-মোকদ্দমায় মোটেই ভীত নই। তবে দেশবাসী ও আমাদের আশংকার কারণ অন্য জায়গায়। সেটা হচ্ছে-অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও ন্যক্কারজনকভাবে দেশ থেকে ন্যায়বিচারের পরিবেশ ও সুযোগ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের পঞ্চম দিনে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি এসব কথা বলেন।
সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, শাসক মহল তাদের অপকর্ম ও অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সব রকমের কারসাজির আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে। সে কারণে অনেকেই বলছেন, শাসক মহলের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে দেশে এখন ন্যায়বিচারের বদলে সৃষ্টি হয়েছ নাই বিচারের পরিবেশ। অর্থাৎ দেশে সুবিচার ও ন্যায়বিচারের কোনো সুযোগ ও পরিবেশ আজ আর নেই।
আত্মপক্ষ সমর্থনে খালেদা জিয়া বলেন, আমার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার, এর প্রতিটি মামলাই আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে। সব মামলাই করা হয়েছে অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো মামলারই কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
বিএনপি নেত্রী বলেন, আমি রাজনীতিতে সক্রিয় বলেই এবং আমাকে ক্ষমতাসীনদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করেই এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে। অথচ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির মামলাগুলো তুলে নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়েও জনগণ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়েই তারা (ক্ষমতাসীনরা) এসব মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিয়েছে।
খালেদা জিয়া আরও বলেন, এসব মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমাকে হেনস্তা করা এবং জনগণের সামনে হেয় করা। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি এবং হবেও না ইনশাআল্লাহ।
ন্যায়বিচারের সুযোগ আরও সীমিত হয়ে পড়েছে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, মাজদার হোসেন মামলার আলোকে সংশ্লিষ্ট সবাই এবং আমরা আশা করেছিলাম, নির্বাহী বিভাগের আওতা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে সত্যিকারের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা কায়েম হবে। কিন্তু সে আশা চরমভাবে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল।
তিনি বলেন, আমরা কী দেখতে পেলাম? সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও আজও নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধি প্রণয়ন করা হয়নি। এর ফলে নিম্ন আদালতগুলো আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবমুক্ত হয়নি।
বরং সাম্প্রতিক কিছু ন্যক্কারজনক ঘটনায় এই আদালতগুলোর ওপর শাসক মহলের রাজনৈতিক চাপ ও কর্তৃত্ব আরও বেড়েছে। ন্যায়বিচারের সুযোগ আরও সীমিত হয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি নেত্রী।
খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রিমকোর্টে সম্প্রতি কী ধরনের ন্যক্কারজনক ও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, আপনি (বিচারক) নিশ্চয়ই তা অবগত রয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে আসীন প্রধান বিচারপতিকে কী ধরনের পরিণতির শিকার হতে হয়েছে- তা সবাই জানেন।
এ সময় সংবাদমাধ্যম নিয়েও কথা বলেন বিএনপি প্রধান। তিনি বলেন, দেশে সংবাদমাধ্যমের এখন কোনো স্বাধীনতা নেই। ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ার ভয়ে তারা সত্য সংবাদ অবাধে প্রকাশ করার সাহস পায় না। তা সত্ত্বেও যতটুকু খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে পেরেছে তাতেই বোঝা গেছে, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে তার পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়া থেকেই প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের অপতৎপরতা শুরু হয় বলেও অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে অসুস্থ ঘোষণা করে ন্যক্কারজনকভাবে জোর করে ছুটিতে এবং দেশের বাইরে যেতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে দেশে না ফিরে পদত্যাগ করতে তাকে বিশেষ পন্থায় বাধ্য করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া।
জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলার বিষয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আমি এ মামলার বিবরণ থেকে জেনেছি এবং কুয়েত দূতাবাসের চিঠিতে জানানো হয়েছে, জিয়াউর রহমানের নামে এতিমখানা স্থাপনের জন্য তারা অনুদান দিয়েছিল। এর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন এবং তিনিই সবকিছু জানতেন।
বিএনপি নেত্রী বলেন, এ মামলার বিবরণ থেকে আমি আরও জেনেছি, কুয়েতের দেয়া অনুদানের অর্থ দুই ভাগ করে দুটি ট্রাস্টকে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আইনের কোনো লংঘন হয়নি এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার কিংবা অন্য কারও কোনোভাবে লাভবান হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, ট্রাস্ট দুটির কোনোটিতেই আমি কোনো পদে কখনও ছিলাম না এবং এখনও নেই। অনুদানের অর্থ আনা বা বিতরণের সঙ্গেও ব্যক্তিগতভাবে বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
আত্মপক্ষ সমর্থনে ১ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আদালতে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিএনপি প্রধান।
এরপর বাকি বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সময় চাইলে আদালত- তা মঞ্জুর করে আগামী ২৩ নভেম্বর দুই মামলার শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।
রাজধানীর বকশীবাজারে স্থাপিত ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দুটির বিচার চলছে।
আদালত সূত্র জানায়, দুর্নীতির এ দুই মামলায় চলতি বছরের ১২ অক্টোবর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আদালত। ১৯ অক্টোবর এ দুই মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। ওই দিন তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি মামলাটি দায়ের করে দুদক।
আর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রাজধানীর রমনা থানায় অপর মামলাটি করা হয়।
বৃহস্পতিবার দুই মামলায় হাজিরা দিতে খালেদা জিয়া সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে আদালতের এজলাসে প্রবেশ করেন।
শুরুতেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী আত্মপক্ষ সমর্থনে খালেদা জিয়ার বক্তব্য প্রাসঙ্গিক রাখার কথা আদালতকে বলেন। এর তীব্র বিরোধিতা করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
এরপর ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন খালেদা জিয়া।
দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে এ দিনের মতো তিনি আংশিক বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন।
আদালতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল আউয়াল মিন্টু, রুহুল কবির রিজভী, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আফরোজা আব্বাস প্রমুখ।
এছাড়া ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, জয়নুল আবেদীন, একে মোহাম্মদ আলী, এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, মো. মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ খালেদা জিয়ার পক্ষে শতাধিক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।