এই দফায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নতুন এ হার আগামী ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে বলে বিইআরসি জানিয়েছে। নয় বছর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর এ পর্যন্ত আট বার বাড়ানো হল বিদ্যুতের দাম।
নতুন হারে আবাসিকে মাসে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়বে ১৫ টাকা, ১৫০ ইউনিটে ৪৮ টাকা, ২৫০ ইউনিট পর্যন্ত ৯০ টাকা, ৪৫০ ইউনিট পর্যন্ত ১৯৬ টাকা এবং ১০০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়বে ৬০৪ টাকা।
তবে ন্যূনতম বিল তুলে দেওয়ায় কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের খরচ কমবে। ১৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের খরচ বাঁচবে ১৭ থেকে ২২ টাকা।
দাম বাড়ানো হয়েছে কেবল খুচরা পর্যায়ে; পাইকারিতে বিতরণ কেন্দ্রগুলোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না।
বৃহস্পতিবার মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, “বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা/কোম্পানিগুলোর বিতরণ খরচ বৃদ্ধি বিবেচনায় খুচরা মূল্যহার বৃদ্ধি করা হয়েছে।”
‘লাইফ লাইন’ গ্রাহকদের ন্যূনতম চার্জ তুলে দেওয়ার গরিব মানুষরা উপকৃত হবেন বলে মনে করছেন তিনি।
এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তীব্র সমালোচনা এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে। এর প্রতিবাদে বাম দলগুলো ৩০ নভেম্বর হরতালও ডেকেছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলছে, বিইআরসির গণশুনানিতে তারা দাম কমানো যে সম্ভব, তা যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল। ফলে এখন দাম বাড়ানোয় গণশুনানি ‘অর্থহীন’ বলে প্রমাণিত হল।
দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে বাম দলগুলো দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে বাম দলগুলো
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। তাতে মাসে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়ে ২০ টাকা; ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারে খরচ বাড়ে কমপক্ষে ৩০ টাকা।
চলতি বছর মার্চে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছিলেন, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করা প্রয়োজন।
এরপর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত সেপ্টেম্বরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে শুনানির আয়োজন করে। সেখানে পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব আসে।
এর মধ্যে ডিপিডিসি গ্রাহক পর্যায়ে ৬.২৪ শতাংশ, ডেসকো ৬.৩৪ শতাংশ, ওজোপাডিকো ১০.৩৬ শতাংশ, আরইবি ১০.৭৫ শতাংশ এবং পিডিবি ১৪.৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। নিয়ম অনুযায়ী, গণশুনানি করার পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনের সিদ্ধান্ত জানাতে হয়।
এবার বিতরণ সংস্থাগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের পাশাপাশি ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) পক্ষ থেকে আনা দাম কমানোর একটি প্রস্তাব নিয়েও শুনানি হয়।
বিইআরসির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খুচরা পর্যায়ে গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুতের ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে মাসে ৫০ ইউনিটের কম ব্যবহার করেন পিডিবির এমন প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহকের (মোট গ্রাহকের ১৩ শতাংশ) বিদ্যুৎ বিল কমবে।
এই দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহকের (মোট গ্রাহকের ৩৮ শতাংশ) মাসিক বিল মোটেও বাড়বে না বলে বিইআরসির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
আগে পিডিবির লাইফ লাইন (৫০ ইউনিট পর্যন্ত) গ্রাহকদের ন্যূনতম চার্জ ছিল ১০০ টাকা এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহকদের ছিল ৯০ টাকা। তবে ন্যূনতম চার্জ কমলেও এসব গ্রাহকদের ২৫ টাকা ডিমান্ড চার্জ থাকছে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে পিডিবির লাইফ লাইন গ্রাহক ১৫ ইউনিট বিদ্যুত ব্যবহার করলে তাকে ১০০ টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে দিতে হবে ৭৮ টাকা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহকদের ১৫ ইউনিট ব্যবহার করে দিতে হচ্ছে ৯০ টাকা। নতুন বিলে তাকে একই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে দিতে হবে ৭৮ থেকে ৮৩ টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, পাইকারি বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট বিক্রির প্রয়োজন পাঁচ টাকা ৪০ পয়সা করে।
“তার বদলে বর্তমানে গড়ে চার টাকা ৮৪ পয়সায় বিক্রি করায় চলতি অর্থবছরে পিডিবির ভর্তুকি গুনতে হবে ৩৬০০ কোটি টাকা।”
খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ায় বিতরণ সংস্থা/কোম্পানিগুলোর ১৭০০ কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে জানান মিজান।
আবাসিকে নতুন হার:
শুন্য থেকে ৫০ ইউনিট তিন টাকা ৫০ পয়সা
শুন্য থেকে ৭৫ ইউনিট চার টাকা
৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পাঁচ টাকা ৪৫ পয়সা
২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট পাঁচ টাকা ৭০ পয়সা
৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট ছয় টাকা দুই পয়সা
৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট নয় টাকা ৩০ পয়সা
৬০০ ইউনিটের বেশি ১০ টাকা ৭০ পয়সা
নতুন হারে আবাসিক গ্রাহকদের মাসিক বিদ্যুৎ বিলে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, তার একটা চিত্র দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে।
>> ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বর্তমান বিল ৩১০ টাকা থেকে চার দশমিক আট শতাংশ বেড়ে হবে ৩২৫ টাকা।
>> ১০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বর্তমান বিল ৪৩৯ টাকা থেকে পাঁচ শতাংশ বেড়ে হবে ৪৬১ টাকা।
১৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বর্তমান বিল ৭১১ টাকা থেকে ছয় দশমিক সাত শতাংশ বেড়ে হবে ৭৫৯ টাকা।
>> ২৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বর্তমান বিল ১২৫১ টাকা থেকে সাত দশমিক দুই শতাংশ বেড়ে হবে ১৩৪১ টাকা।
>> ৩৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বর্তমান বিল ১৮১৫ টাকা থেকে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ বেড়ে হবে ১৯৫২ টাকা।
>> ৪৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বর্তমান বিল ২৫৪৭ টাকা থেকে সাত দশমিক সাত শতাংশ বেড়ে হবে ২৭৪৩ টাকা।
>> ১০০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বর্তমান বিল ৭৯৩৯ টাকা থেকে সাত দশমিক সাত শতাংশ বেড়ে হবে ৮৫৪৩ টাকা।
কৃষি সেচ পাম্পে প্রতি ইউনিটের মূল্য ধরা হয়েছে চার টাকা। ৭৫০ ইউনিট ব্যবহার করে বর্তমানে দুই হাজার ৮৯৫ টাকা দিতে হচ্ছে। ছয় দশমিক দুই শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় নতুন মূল্যে দিতে হবে তিন হাজার ৭৫ টাকা।
খুচরা পর্যায়ে কোন খাতে কী প্রভাব খুচরা পর্যায়ে কোন খাতে কী প্রভাব:
বিইআরসির চেয়ারম্যান জানান, মৌসুম শেষ হলে সেচ পাম্পের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে এবং মৌসুমের সময় আবার চালুও করা যাবে। এক্ষেত্রে সংযোগ বন্ধের সময়ের জন্য কোনো চার্জ গুনতে হবে না।
ক্ষুদ্র বাণিজ্যিক সংযোগে বর্তমানে ২০০ ইউনিটের জন্য দুই হাজার ২০ টাকা থেকে পাঁচ শতাংশ বেড়ে হবে দুই হাজার ১২০ টাকা।
বৃহৎ বাণিজ্যিক সংযোগে ১৫ হাজার ইউনিটের ক্ষেত্রে ১০ দশমিক ছয় শতাংশ বেড়ে এক লাখ ১৮ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে এক লাখ ৩১ হাজার টাকা হবে।
ক্ষুদ্র শিল্পে দুই হাজার ইউনিটের জন্য সাড়ে সাত শতাংশ বেড়ে ১৫ হাজার ৩৯০ টাকা থেকে ১৬ হাজার ৫৫০ টাকা হবে।
মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার ইউনিট ব্যবহার করলে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩০০ টাকা থেকে সাড়ে সাত শতাংশ বেড়ে এক লাখ ৬৮ হাজার টাকা।
বৃহৎ শিল্পে ২০ লাখ ইউনিট ব্যবহারে সাত দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে নতুন বিল দিতে হবে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা।