আমার বাড়ি আর আমাদের বাড়ির পার্থক্য যে এতটা বেশি তা জয়ীর সঙ্গে কথা না হলে হয়তো কখনো বুঝতেই পারতাম না। কলেজপড়ুয়া জয়ী থাকে হোস্টেলে। ছোটখাটো ছুটিতে যেখানে সবাই একটু ফুরসত খুঁজে বাড়ি ফেরা—সেখানে জয়ীর আগ্রহ নেই বললেই চলে। ঈদ কিংবা পূজার লম্বা ছুটিতে খানিকটা বাধ্য হয়েই তাকে বাড়ি ফিরতে হয়। সেদিন ওকে বললাম, তুমি আর আগের মতো বাড়ি আসো না যে! জয়ী নির্লিপ্তভাবে বলল, আসলে বাবার বাড়ি আর মায়ের বাড়ি করে করে আমি ক্লান্ত। নিজেকে যাযাবর মনে হয়। যতই দিন যাচ্ছে ততই কেমন জানি ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছি। অথচ দেখ ব্যাপারটা এমন না যে তারা আমার দেখাশোনা করছে না বা যত্ন নিচ্ছে না। বাবা-মায়ের মিল ছিল না, তারা বাধ্য হয়েই আলাদা হয়েছে। তখন মনে হতো প্রতিনিয়ত ঝগড়া আর চিৎকার-চেঁচামেচি করার চেয়ে তারা আলাদা থাকুক। তবুও ভালো থাকুক। কী আশ্চর্য! এখন আমি এই সহজ সত্যিটাই মানতে পারছি না। আর আমার মায়ের স্বামী মানে আমার নতুন বাবাও মানুষ হিসেবে খারাপ না। আবার আমার বাবার অনেক খারাপ দিক আছে তা জানি কিন্তু অন্য কাউকে বাবার আসনে বসানো খুব ভয়ংকর ব্যাপার। অনেক ছোট বয়সে হলে হয়তো মানতে পারতাম কিন্তু এখন কেন জানি খুব অস্বস্তি লাগে। বাবা-মায়ের রিপ্লেসমেন্ট কি অন্য কাউকে দিয়ে করা সম্ভব, বলো!
বাবা-মায়ের যখন ডিভোর্স হয় অনিকের বয়স তখন সাত কি আট বছর। বাবার স্মৃতি খুব একটা মনে পড়ে না। বর্তমানে যদিও পিতা-পুত্রের বসবাস একই শহরে। কিন্তু বাবা প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ। আগের পক্ষের ছেলের খোঁজ নেওয়ার সময় তার খুব একটা হয়ে ওঠে না! দুটি টিউশনি করে নিজে নিজেই চলে অনিক। পড়াশোনায় বেশ ভালো হলেও বন্ধুবান্ধব খুব একটা তার কখনো হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে তার সঙ্গে কেউ মেশেনি আর বড় হওয়ার পর সে নিজেই একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে সব সময়। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে কিংবা হলে বসে সবাই যখন আড্ডা দেয়, হই-হুল্লোড় করে তখন সে চুপ করে এক কোণে বসে থাকে ঠিক ছেলেবেলার মতো। আর কথা প্রসঙ্গে বাবা-মা এলেই সে কোনো একটা অজুহাত দিয়ে সটকে পড়ে। আজ পর্যন্ত নিজের বাবা-মা প্রসঙ্গে সে একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। অনিকেরও মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে করে বাবা-মায়ের গল্প করতে। কিন্তু ওদের মতো তার তো কোনো গল্প নেই, আনন্দময় কোনো স্মৃতি নেই! অথচ তার চাওয়া ছিল খুব সাধারণ একটা জীবন। সে-ও বাবা-মায়ের মাঝখানে থেকে সুখী হতে চেয়েছিল। ছোটবেলায় সমবয়সী ছেলেমেয়েরা ওকে খেলায় নিত না। সত্যি বলতে ওদের বাবা-মায়েদের কঠোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাপ ছাড়া ছেলে যে কি-না দুদিন পরেই গোল্লায় যাবে তার সঙ্গে মেশার সাহস কারও হতো না।
গ্রাম কিংবা অভিজাত শহর যা-ই হোক না কেন, ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চাদের প্রতি মানুষের মনোভাব মোটামুটি একই। অনেকেই মনে করেন বিচ্ছিন্ন পরিবারের বাচ্চাদের ভালোভাবে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ! আর তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক কিছু প্রত্যাশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ অনেক ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়ে সব প্রতিকূলতা পার হয়ে নিজ যোগ্যতায় খুব ভালো অবস্থানে নিজেদের নিয়ে গেছে।
বিচ্ছিন্ন পরিবারের সন্তানদের কথা ভাবুন তো—এমনিতেই তাদের পরিবার নামক আস্থা আর ভালোবাসার জায়গাটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তার ওপর পাশের বাসার আন্টি-আঙ্কেল বা নিকটতম প্রতিবেশীরা যদি এই কথাটা বারবার মনে করিয়ে দেয় তবে ব্যাপারটা কেমন হয়, একটু ভাবুন তো। তাদের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পেছনে অবশ্যই বড় কোনো ঘটনা বা কারণ রয়েছে। তারা হয়তো পরিস্থিতির কারণে তাদের সন্তানদের প্রতি এমন অবিচার করতে বাধ্য হয়েছেন। সে জন্য তো আমরা তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেই চলেছি, ভালো কথা। কিন্তু প্রতিনিয়ত নিজেদের আচার-আচরণে এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছি যে তারা সমাজের একটা চিহ্নিত অংশ, এই সমাজ তাদের ভালোভাবে কখনোই মেনে নেবে না।
একটা পরিবার ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের আশা আর স্বপ্নও ভেঙে যায়। তাদের ওপর প্রচণ্ড রকমের চাপ থাকে আর সুযোগ পেলেই সামাজিকভাবে হেয় করা হয় তাদের। অনেকে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে স্কুল ছেড়ে দেয়। তুখোড় মেধাবী ছাত্রদের অনেকেই মাঝপথে ঝরে পড়ে। সেই ছোট্ট বাচ্চাদের প্রতি অন্যদের অবজ্ঞার আচরণ অথবা তাদের বাবা-মাকে হেয় করে কথা বলা সত্যিকার অর্থেই তাদের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অন্য আট-দশটা ছেলেমেয়ের মতো স্বাভাবিকভাবে সবার সঙ্গে তারা মিশতে পারে না। মন খুলে নিজের কথাগুলো বলতে পারে না। সমবয়সীদের সঙ্গে উচ্ছলতায় মেতে উঠতে পারে না। অদৃশ্য শিকলে বাঁধা থাকে তাদের রঙিন শৈশব-কৈশোর। এই হীনম্মন্যতা আর মানসিক চাপ থেকে হয়তো তাদের পুরোপুরি মুক্তি দিতে পারব না কিন্তু নিজেদের তৈরি মনগড়া সামাজিক চাপ থেকে তো মুক্তি দেওয়াই যায়, তাই না?
লেখক: শামীমা ইয়াসমিন, চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।