‘গুম’ করার উদ্দেশ্যে তাকে ধরে নেওয়া হয়েছিল দাবি করে ফরহাদ মজহার বলেছেন, সেখান থেকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জোরাল ভূমিকা রেখেছে, তবে পরে চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
ফরহাদ মজহারকে অপহরণের ‘মিথ্যা’ অভিযোগ দেওয়ার অভিযোগে তার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ আদালতের অনুমতি নেওয়ার একদিন পর শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসে একথা বললেন এই লেখক-প্রাবন্ধিক।
গত ৩ জুলাই সকালে রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে বেরিয়ে ফরহাদ মজহারের নিখোঁজ হন। বিষয়টি নিয়ে সব মহলে আলোচনার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা পর গভীর রাতে নাটকীয়ভাবে যশোরে বাস থেকে তাকে উদ্ধার করে র্যাব।
এ ঘটনায় ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতারের করা মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ বলেছে, ফরহাদ মজহারকে অপহরণের প্রমাণ পাননি তারা।
পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে মজহার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করার অনুমতি চায় পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার তাদের ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা করার অনুমতি দিয়েছে আদালত।
এই প্রেক্ষাপটে শনিবার রাতে শ্যামলীতে নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহার বলেন, “গুমের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা তাদের সাফল্য ও গৌরবকে মারাত্মকভাবে ম্লান করে দেওয়া হল।”
ঘটনার পাঁচ মাস পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ‘অপহরণ’ ও উদ্ধারের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, চোখের সমস্যার জন্য ওষুধ কিনতে ভোরে বাসা থেকে বের হলে তিনজন লোক তাকে জোর করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে সময় ফোন তার হাতে স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ডায়াল করা অবস্থায় থাকায় প্রথম ফোনটি তার কাছে যায়।
“এরপর বাঁচার জন্য টেলিফোন করা, টাকা পাঠানোসহ অপহরণকারীরা যা কিছু করতে বলে আমি তা করি।”
পরে অচেনা একটি জায়গায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, তার উপর নজর রাখা হচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারছিলেন। পরে তাদের নির্দেশ মতো সন্ধ্যায় হানিফ পরিবহনের একটি বাসে উঠেন তিনি।
“আমি মৃত্যুভয়ে ভীত, বিধ্বস্ত ও শারীরিক অসুস্থতায় নির্জীব হয়ে পড়ি। সোরগোল শুনে আমি জেগে উঠি, কিছু সাদা পোশাকের লোক জোর করে আমাকে আবার নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। আমাকে আবার মারবার জন্য নামানো হচ্ছে ভেবে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, কিন্তু সাদা পোশাকের কিছু ব্যক্তি র্যাবের দিকে বন্দুক তুলে শাসিয়ে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড বচসা ও তর্কাতর্কি হয়।”
এ সময় র্যাব সদস্যরা ‘রীতিমতো ছোটখাট যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে’ তাকে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে আশ্বস্ত করে বলে জানান ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, সাদা পোশাকের ওই ব্যক্তিরা আবারও তাকে র্যাবের গাড়ি থেকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করে। পরে র্যাব তাকে খুলনায় নিয়ে চিকিৎসা ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে।
পরে ঢাকার ফেরার পথে রাস্তায় ট্রাক দিয়ে পথ রোধ করে র্যাবের গাড়ি আটকে তাদের অভয়নগর থানায় নেওয়া হয় বলে জানান ফরহাদ মজহার।
“আমাকে জোর করে র্যাবের গাড়ি থেকে নামানো হয়, আমার সঙ্গে তারা প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমাকে বলতে বাধ্য করা হয় যে, আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি এবং তাদের কাছে ভিডিওসহ অন্যান্য প্রমাণ আছে।
“আমাকে ক্যামেরাসহ কিছু লোকের সামনে দাঁড় করানো হয়, সাংবাদিকদের সামনে আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি বলে স্বীকার করানোর জন্য প্রচণ্ড চাপ দেয়, অনেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।”
পরে সেখান থেকে পুলিশের গাড়িতে ঢাকায় আসার পর আদাবর থানা হয়ে তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয় জানিয়ে ফরহাদ বলেন, “হতভম্ব, ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য একটি লিখিত কপি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়।”
পুলিশের দেওয়া ওই কাগজই আদালতে গিয়ে বিচারের কাছে দেন বলে দাবি করেন তিনি।
এতোদিন কেন এসব কথা বলেননি-প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ মজহার বলেন, “অপহৃত হওয়ার পর যারা ফিরে এসেছেন কেউ কথা বলেননি। আমি কথা বলে নিজেকে আরও বিপদে ফেলছি। তবে আমি যতই লাঞ্ছিত হই, এই লড়াইটা চালিয়ে যাব।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতজন গুম হয়েছে, তাদের একজন হয়ে আমি এখানে এসেছি। আদালতে শুনানি হবে। আইনি প্রক্রিয়ায়, যা হবে তাই মেনে নেব।”
ফরিদা আখতার অভিযোগ করেন, মামলার তদন্ত চলাকালে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে তাদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক চাপ তৈরি করা হয় এবং তাদের তদন্তে সায় না দিলে মামলার হুমকি দেওয়া হয়। ন্যায়বিচার পেতে এখন উচ্চ আদালতে যাবেন তারা।
ফরহাদ মজহার ঘটনার ওই বিবরণ দিলেও প্রথম দিন থেকেই পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অপহরণের কোনো নজির তারা পাননি; ফরহাদ মজহার নিজেই অপহরণের ‘নাটক’ করেছিলেন বলে তারা মনে করছেন।
এ বিষয়ে তদন্ত শুরুর পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গত ১০ জুলাই ঢাকার আদালতে অর্চনা রানি নামে এক নারীকে হাজির করে। নিজেকে ফরহাদ মজহারের ‘শিষ্য’ বলে জবানবন্দিতে দাবি করেন তিনি।
সেখানে তিনি বলেন, সেদিন ফরহাদ মজহার তার জন্য অর্থ জোগাড় করতেই বেরিয়েছিলেন এবং ১৫ হাজার টাকাও পাঠিয়েছিলেন।
খুলনায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টের দোকানে ফরহাদ মজহারের যাওয়ার এবং ওই এলাকায় তার একাকী ঘোরাফেরার একটি ভিডিও পরে সাংবাদিকদের সরবরাহ করে পুলিশ।
ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মাহবুবুল হক গত ১৪ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে ফরহাদ মজহার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি চান।
তার ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে এই দম্পতির বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২১১ ও ১০৯ ধারায় মামলার অনুমতি দিয়েছে আদালত।
ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কেউ কোনো অভিযোগ দায়ের করলে অথবা কোনো অপরাধ করেছে বলে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।
তবে অভিযোগের বিষয় যদি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা সাত বছরের বেশি সাজার যোগ্য হয়, আর সেই অভিযোগ যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে মিথ্যা অভিযোগকারীর সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড হবে।
আর ১০৯ ধারায় অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়া, উসকানি দেওয়া বা সহযোগিতার বিষয়ে বলা হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে আসামি যে অপরাধ করার ষড়যন্ত্র করেছেন বলে প্রমাণিত হবে, তার ক্ষেত্রে সেই অপরাধের শাস্তিই প্রযোজ্য হবে।