তাবলিগ জামাতের মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক অংশের বিক্ষোভের মুখে মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে বাইরে রেখেই বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে আজ শুক্রবার। এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম অরাজনৈতিক সংগঠন তাবলিগ জামাতের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সামনে এসেছে।
ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দিনের তাবলিগ জামাতের মারকাজের (প্রধান কেন্দ্র) আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভী কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমার ইমামতি ও আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করে আসছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে তাবলিগের একাংশ গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত রাজধানীতে বিক্ষোভ করে। বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় সচিবালয়ে তাবলিগের দুই পক্ষের বৈঠক হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয়, সাদ কান্ধলভী ইজতেমায় অংশ নেবেন না।
প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ভারতের তাবলিগ জামাতের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভী বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে থাকবেন, ততক্ষণ কাকরাইল মসজিদে অবস্থান করবেন। সুবিধামতো সময়ে তিনি ভারতে চলে যাবেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।
রাজধানীর অদূরে টঙ্গীর তুরাগে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক ইজতেমা শুরু হচ্ছে আজ। এবারই প্রথম ইজতেমা সামনে রেখে তাবলিগ জামাতে এমন বিভক্তি দেখা গেল। গত বুধবার দুপুরে থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে সাদ কান্ধলভী ঢাকায় আসেন। তাঁর আগমন ঠেকাতে ওই দিন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের রাস্তা প্রায় সাত ঘণ্টা অবরোধ করে রেখেছিল তাবলিগের একটা অংশ, যাঁরা মূলত ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার পাঠক্রম অনুসরণকারী কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ছিলেন। অন্যদিকে তাবলিগের সাদ কান্ধলভীকে যে অংশটি এ দেশে নিয়ে এসেছে, তাঁরা মূলত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেবল এ দেশের তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বই নয়, দিল্লির মারকাজের নেতৃত্বের বিভেদও ঢাকার বিক্ষোভের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে।
সাদ কান্ধলভী কড়া পুলিশি পাহারায় কাকরাইল মাদ্রাসায় রাত কাটান। গতকাল সকাল থেকেই কাকরাইল মাদ্রাসার আশপাশে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন কান্ধলভীবিরোধী তাবলিগের ‘সাথিরা’। পুলিশের বাধার কারণে জড়ো হতে পারেননি। দুপুর ১২টার দিকে মৎস্য ভবনের সামনে থেকে হাজারখানেক তাবলিগ সদস্য কাকরাইল মসজিদ ঘেরাও করার প্রস্তুতি নেন। পুলিশি বাধায় সে চেষ্টা ভেস্তে যায়। পরে তাঁরা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জমায়েত হন। এ সময় কাকরাইল মসজিদ ও বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তবে সাদ কান্ধলভীর সমর্থকেরা রাস্তায় নামেননি। এই অংশটির নিয়ন্ত্রণে আছে বাংলাদেশে তাবলিগের মারকাজ (প্রধান কেন্দ্র) কাকরাইল মসজিদ।
গতকাল সকালের দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এলাকার পরিস্থিতি দেখতে যান। পরে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মাওলানা সাদ আজ সকালে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম ভাগে যোগ দিতে যাচ্ছেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহাখালীর আইপিএইচ স্কুল ও কলেজের ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন। সে সময় তিনি বলেন, সরকার শুধু আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি দেখবে। মাওলানা সাদ কান্ধলভী থাকবেন কি থাকবেন না, সে সিদ্ধান্ত নেবেন তাবলিগ জামাতের মুরব্বিরা। দুপুর পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান।
এর আগে বেলা দেড়টার দিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে সাদ কান্ধলভীবিরোধীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। তাতে বক্তব্য দেন ফজলুল করিম কাশেমি, যিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ঢাকা মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘পুলিশ কমিশনার সাহেব বলেছেন, সাদ কান্ধলভী ইজতেমায় অংশ নেবেন না। তবে এতে আমরা খুশি না, সূর্য ডোবার আগেই তাঁকে এখান থেকে সরাইতে হবে। সরাইলে দেশ শান্ত হবে, ঢাকা শহর শান্ত হবে, গাড়িগুড়ি চলবে। আর না হলে সব বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ তিনি বাংলাদেশে যাঁরা সাদ কান্ধলভীকে তাবলিগ জামাতের আমির বলে মনে করেন এবং কাকরাইল মসজিদে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছেন, তাঁদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
সাদ কান্ধলভীকে নিয়ে আপত্তি কোথায়? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে ফজলুল করিম কাশেমি বলেন, ‘তিনি স্বঘোষিত আমির। তাঁকে মাওলানা শাহ আহমদ শফীসহ (হেফাজতের আমির) উলামায়ে কেরামরা মানেন না। তিনি হাদিসের অপব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন, কওমি মাদ্রাসার খেদমত যাঁরা করেন, তাঁদের ব্যাপারে আপত্তিকর কথা বলেছেন। শুধু তা-ই নয়, হজরত মুসা (আ.)-কে নিয়ে বেয়াদবিমূলক কথা বলেছেন।’ তিনি বলেন, তাবলিগ জামাতের আমির নির্বাচিত হন মজলিশে শুরার মাধ্যমে। সাদ নিজে নিজেই আমির হয়ে গেছেন।
কাকরাইল মসজিদ বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র হলেও কেন বায়তুল মোকাররমে সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে-এ প্রশ্নের জবাবে ফজলুল করিম কাশেমি বলেন, তাঁরা পুলিশি বাধায় কাকরাইলে ঢুকতে পারছেন না। তিনি দাবি করেন, সাদপন্থীদের সংখ্যা ১০-১২ জনের বেশি না। তাঁদের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম ও খান শাহাবুদ্দীন নাসিম।
অবশ্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম ও খান শাহাবুদ্দীন নাসিম-কারোরই বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দুজনের মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
গতকাল দিনভর কাকরাইল মসজিদ ছিল কড়া পুলিশি পাহারায়। ভেতরে ছিলেন সাদ কান্ধলভী। বেলা দুইটার দিকে কাকরাইল মসজিদের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন তাবলিগের লোক দাঁড়িয়ে আছেন। ইজতেমার ভবিষ্যৎ কী-তাঁরা সেটা বুঝতে চাচ্ছিলেন। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, সাদ কান্ধলভী মেহমান। মেহমানকে এভাবে অপদস্থ করার কোনো মানে হয় না। তাঁকে প্রতিহত করতে বুধবার তাবলিগ জামাতের নামে বিমানবন্দর এলাকায় যা ঘটেছে তা ঠিক হয়নি। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি।
নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব
তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ভারতের মাওলানা ইলিয়াস (রা.)। তাঁর মৃত্যুর পর তাবলিগের ‘জিম্মাদার’ বা প্রধান হন মাওলানা ইউসুফ (রা.)। এরপর দায়িত্বে আসেন মাওলানা এনামুল হাসান।
বাংলাদেশে তাবলিগের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ব্যক্তি জানান, মাওলানা এনামুল হাসান তাঁর জীবদ্দশাতেই উত্তরসূরি নির্ধারণের উদ্যোগ নেন। তিনি ১০ সদস্যের একটি শুরা কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটিতে একজন বাংলাদেশিও ছিলেন। তাঁর নাম আবদুল মুহিত, পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী। তিনি জীবিত নেই। ওই শুরা কমিটি তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াসের (রা.) নাতির ছেলে সাদ কান্ধলভীসহ তিনজনের হাতে তাবলিগের ‘জিম্মাদারির’ দায়িত্ব দেন। তাবলিগ জামাতের যেকোনো বিষয়ে এই তিনজন আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিতেন। অপর দুজনের মৃত্যুর পর সাদ কান্ধলভী একাই তাবলিগ জামাত পরিচালনা করছেন।
তাবলিগ জামাতে যুক্ত ঢাকার একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাদ কান্ধলভী নিজেই আমির হয়ে গেছেন, এই অভিযোগ সত্য নয়। তবে তাঁকে নিয়ে তাবলিগ জামাতের কোনো কোনো মুরব্বির অস্বস্তি ছিল। তাঁরা শুরা সদস্যদের দিয়ে তাবলিগ পরিচালিত হোক, এমনই চাইছিলেন। বছর তিনেক আগে পাকিস্তানে বৈঠক করে তাঁরা তাবলিগ জামাত পরিচালনার জন্য ১৩ সদস্যের একটি শুরা কমিটি গঠন করেন। কিন্তু সাদ কান্ধলভী ওই শুরা কমিটির অনুমোদন দেননি।
বিতর্কিত মন্তব্য প্রসঙ্গে তাবলিগের এই সাথি বলেন, সাদ কান্ধলভীর মন্তব্য নিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসা অভিযোগ তোলে। পরে মাওলানা সাদ ওই মন্তব্যগুলো প্রত্যাহারও করে নেন। মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশ থেকে তাবলিগের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন গিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা অনাপত্তির কথাও জানিয়ে দেন। তারপরও বিষয়টি নিয়ে হইচই হচ্ছে মূলত সাদ কান্ধলভীকে বিপাকে ফেলে ১৩ সদস্যের শুরা কমিটির অনুমোদন নেওয়ার জন্য।
তবে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সম্পাদক ও তাবলিগের সাথি ফজলুল হক কাশেমি গতকাল সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, তাবলিগ জামাতে নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এসব অভিযোগ অসত্য।
এর আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর সকালে কাকরাইল মসজিদে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। সেখানে পুলিশও যায়। পরে তারা ঐকমত্যে পৌঁছায়, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শুরার সদস্যরা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। পাঁচজন আলেমকে মজলিশে শুরার পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত করা হয়। তাঁরা হলেন মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ, মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ ও মাওলানা আবদুল মালেক।
এই উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য হলেন বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৩ সদস্যের শুরা কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শ নেওয়ার কথা। কিন্তু সাদ কান্ধলভীর আসার ব্যাপারে উপদেষ্টা পরিষদকে জানানো হয়নি। এমনকি শুরা কমিটির সবাই বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন না। সাদ কান্ধলভীকে নিয়ে দিল্লিতেও সমস্যা হচ্ছে বলে দাবি করেন আবদুল কুদ্দুছ।