বিএনপি বলছে, প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নতুন কিছু ভেবে থাকেন, তাহলে তাঁর উচিত হবে এ নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করার উদ্যোগ নেওয়া।
সংবিধান অনুযায়ী ভোটের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে—প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আজ শনিবার বিকেলে বিএনপির পক্ষ থেকে এ কথা বলা হয়। জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটি সংবাদ সম্মেলন করে। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা আমাদের সংবিধানে সম্পূর্ণভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনারকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নির্বাচনকে ঘিরে বিদ্যমান সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। সংবিধানে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বিধান নেই। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী যদি সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। কারণ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারও হবে বিদ্যমান সরকারেরই অনুরূপ। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবে, এমন কিছু উল্লেখ নেই। সংবিধানের ১৫তম ও ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শাসনকে পাকাপোক্ত করার একটি ব্যবস্থাই করা হয়েছে মাত্র। সংবিধান ও গণতন্ত্র সব সময় সমার্থক বা সমান্তরাল হয় না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন কিছু ভেবে থাকেন, তাহলে তাঁর উচিত হবে এ নিয়ে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিএনপি মনে করে একটি আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে ২০১৮–এর নির্বাচন সম্পর্কে অর্থবহ সমাধানে আসা সম্ভব। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বিএনপির একটি চিন্তাভাবনা আছে। একটি সুন্দর পরিবেশে সংলাপটি অনুষ্ঠিত হলে জাতির মনে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে বিএনপি আস্থা রাখতে চায়।
লিখিত বক্তব্যের শুরুতেই বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ভাষণ জাতিকে হতাশ, বিস্ময়-বিমূঢ় ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই ভাষণে বিদ্যমান জাতীয় সংকট নিরসনে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা খুবই অস্পষ্ট, ধোঁয়াশাপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। জাতি আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রিত্বের এই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার এক বছর আগেই তিনি যে ভাষণ দেবেন, সে ভাষণে থাকবে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা, জাতীয় সংকট নিরসনে একটি স্পষ্ট রূপরেখা। আর জনগণের উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য থাকবে বিভ্রান্তির বেড়াজালমুক্ত কর্ম পদক্ষেপ।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে উন্নয়নের এক চোখধাঁধানো বয়ান পেশ করেছেন। বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে তাঁদের দাবির সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও একমত হতে পারেনি। আমদানি–রপ্তানি, বৈদেশিক আয়, ঋণপ্রবাহ প্রভৃতির সঙ্গে সরকারের প্রবৃদ্ধি–সংক্রান্ত প্রাক্কলনের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি করে সরকার বরাবরই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীও তা–ই করলেন। তিনি আরও বলেন, সরকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের উন্নয়নের বয়ানকে দৃশ্যমান করার জন্য কোশেস করছে। এসব প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, দেশের মানুষের রক্ত চুষে লাখ লাখ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাঠানোর ফলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কমে এসেছে। মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে আর বেকার সমস্যা বাড়ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু টাকা পাচার রোধে দৃশ্যত সরকারের কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। কারণ দেশের ভেতর বিভিন্নভাবে লুটপাট করে অবৈধভাবে অর্জিত এসব টাকা বিদেশে পাচার করার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী ঘরানার লোক বা আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট। তিনি আরও বলেন, গত ১০ বছরে কমপক্ষে ৭৫০ জন গণতন্ত্রকামী কর্মীকে গুম করেছে সরকারি বাহিনী। অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ২০১৭ সালে সরকারি বাহিনী কর্তৃক গুমের শিকার ৮৬ জন। তাঁদের মধ্যে ৯ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ৪৫ জনকে গুম–পরবর্তী আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। ১৬ জনকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৬ জনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। গুম ও খুনের শিকার পরিবারগুলোই বোঝে তাদের কী কষ্ট।