জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ মামলার ছয়জন আসামি প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। অর্থনৈতিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে এবং এর বাজে প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে সংক্রামিত হয়।
রায় ঘোষণার ১২ দিন পর আজ সোমবার বিকেল ৪টার দিকে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন বিচারক। এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের হাতে ৪টা ২৫ মিনিটে মামলার রায়ের কপি হাতে তুলে দেন আদালতের পেশকার মোকাররম হোসেন। এরপর পরই দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের হাতেও মামলার রায়ের কপি তুলে দেয়া হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, নথি পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয় খালেদা জিয়া এ দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্বীকৃত মতেই সরকারি কর্মচারী। বাকি উপাদানগুলো এ মামলায় উপস্থিত আছে বলে ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। ফলে খালেদা জিয়ার পক্ষে যে সমস্ত যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে তা বাস্তবতার নিরীখে গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই।
এছাড়াও আসামিদের পক্ষে দাবি করা হয়েছে যে, তিনি (খালেদা জিয়া) আইনের বিধান লঙ্ঘন করেন নাই এবং সে দুটি ট্রাস্টের অর্থ প্রদান করেছেন তাও সঠিক আছে। কিন্তু নথির পর্যালোচনায় আসামিপক্ষ উপস্থাপিত যুক্তি গ্রহণযোগ্য হয়নি। কেননা সরকারি এতিম তহবিলের টাকা বিধি মোতাবেক এতিমদের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নাম সর্বস্ব জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট্রের অনুকূলে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা স্থানান্তর করেন।
মামলার আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে এতিম তহবিলের ২ কোটি ৭১ লাখ ৬৩৪ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পরিমাণের দিক থেকে এর বর্তমানমূল্য অধিক না হলেও ঘটনার সময়ে ওই টাকার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নামে কোনো এতিম খানার অস্তিত্ব পাওয়া যায় নাই। সেখানে কোনো এতিম বসবাস করে না। এতিম খানার কোনো দালান-কোঠা বা স্থাপনা নেই। ফলে আসামিদের কোনো যুক্তি গ্রহণ যোগ্য নয়। রাষ্ট্রের যুক্তি গ্রহণযোগ্য।
সব কিছু বিবেচনা করে এটা প্রতিয়মান হয় যে, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯ ও ১০৯ এবং দুদকের আইনের ৫ (২) ধারা প্রমাণিত হয়েছে। ৪০৯ ধারার বিধান মতে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা যে কোনো বর্ণনায় কারাদণ্ডের মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। আসামিরা একে অপরের সহযোগিতায় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন এবং সে কারণে তাদের সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। তবে আসামিদের বয়স ও সামাজিকতা অবস্থান এবং আত্মসাৎকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনায় গ্রহণ করে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা সমীচীন হবে না মর্মে আদালত মনে করেন। আসামি খালেদা জিয়া এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক দলের কর্ণধার, বয়স্ক মহিলা, শারীরিক ও সামাজিকতা বিবেচনায় তাকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং তারেক রহমানসহ বাকিদের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন।
অন্যদিকে ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট এর ২৬ ধারায় বিধান বিবেচনায় আসামিদের যে কোনো একটি আইনে দণ্ডিত করে আদেশ প্রচার করা বিধান বলে আদালত মনে করেন।
রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও জাকির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার রায়ের সার্টিফায়েড কপি আমরা হাতে পেয়েছি। আগামীকাল মঙ্গলবার উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে আবেদন করবো।
দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, আমরা রায়ের কপি দুদকের কমিশনের কাছে হস্তান্তর করবো। রায়ের কপি দেখে কমিশন সিদ্ধান্ত নিবেন।
আদালতের পেশকার মোকাররম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের ১১৬৮ পৃষ্ঠার সার্টিফায়েড কপি খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের হাতে দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ মামলায় অন্য আসামি খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ পাঁচ জনকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। অপর চার আসামি হলেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক মুখ্যসচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। আদালত দণ্ডবিধি ১০৯ ও ৪০৯ ধারায় এ রায় ঘোষণা করা করেন। কারাদণ্ডের পাশাপাশি সব আসামিকে দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়।