দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন শিল্প বিকাশের এখনই উপযুক্ত সময়। এজন্য সম্পূর্ন তৈরি (সিবিইউ) মোবাইল ফোনসেট আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা, গবেষক এবং অর্থনীতিবিদগণ। তাঁদের মতে, এখনই মোবাইল ফোন উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিতে হবে, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। অন্যদিকে আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক বাড়াতে হবে। তাহলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, সুযোগ হবে কর্মসংস্থানের। তৈরি হবে দক্ষ জনবল। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
আগামি অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত উত্থাপিত বাজেটে দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন উৎসাহিত করতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা রেখেছেন। প্রকৃত উৎপাদনকারীদের জন্য ভ্যাট ও সারচার্জ অব্যাহতি থাকছে। তবে এই সুবিধা পেতে উৎপাদনকারীদের প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড (পিসিবি), হাউজিং অ্যান্ড কেসিং, ব্যাটারি, চার্জার উৎপাদন সক্ষমতাসহ সংশ্লিষ্ট পণ্যের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে এই শুল্ক কাঠামো দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন শিল্প বিকাশের অনুকুল বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যেক্তারা। তাদের মতে, এই বাজেট বাস্তবায়ন হলে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেটের প্রকৃত উৎপাদনকারী গড়ে উঠবে। তবে দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে হ্যান্ডসেট আমদানির ওপর শুল্ক আরো বাড়ানো প্রয়োজন।
কম্পিউটার অ্যান্ড মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (প্রস্তাবিত) মহাসচিব মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন (এসিএস) বলেন, বাজেটে প্রযুক্তিপণ্যে আমদানি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে উৎপাদনমুখী হওয়ার প্রবণতা প্রসংশনীয়। দেশেই মানসম্মত ফোরজি স্মার্টফোন তৈরি হচ্ছে। তাই এখন হ্যান্ডসেট আমদানির ওপর শুল্ক আরো বাড়ানো প্রয়োজন। তাতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং আমদানি নিরুৎসাহিত হবে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশীয় মোবাইল ফোন উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাজেটে বেশকিছু সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। দেশে মোবাইল ফোন যারা বানাচ্ছেন, এ্যাসেম্বলিং যারা করছেন, তাদের জন্য তো বটেই, দেশীয় শিল্প বিকাশেও এটি ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি যোগ করেন, দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারে, সে ধরনের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করাও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
পলিসি রিসার্চ ইন্সিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট দেশে প্রকৃত মোবাইল ফোন উৎপাদন শিল্প বিকাশের জন্য সহায়ক ও সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত। প্রস্তাবনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- দেশে মোবাইল ফোন সংযোজন শিল্প নয়; বরং ভ্যালু এ্যাডিং ইন্ডাস্ট্রি অর্থাৎ প্রকৃত মোবাইল ফোন উৎপাদন শিল্পের বিকাশ ঘটানো। যাতে শুধুমাত্র পার্টস সংযোজন করা হয় এমন শিল্পের পরিবর্তে লোকাল কম্পোনেন্ট উৎপাদন বাড়বে এমন ধরনের দেশীয় হ্যান্ডসেট শিল্প গড়ে উঠার দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যে সকল উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে দেশে মোবাইল ফোন সংযোজন শিল্পে বিনিয়োগ করেছেন, তৈরি হ্যান্ডসেট আমদানির উপর শুল্ক আরো বাড়ানোর মাধ্যমে সেসব উদ্যোক্তাদের স্বল্পমেয়াদে প্রোটেকশন দিতে পারে সরকার। তবে, তা যেন দীর্ঘমেয়াদি না হয়। এতে করে সংযোজন শিল্পের উদ্যোক্তারাও তাদের বিনিয়োগকে লোকাল কম্পোনেন্ট উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, এবারের বাজেটটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট। এক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ের হার বাড়ানোর পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদকদের এগিয়ে নিতে হবে। তাহলে দেশও এগিয়ে যাবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কেবিএম মাহবুবুর রহমান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে মোবাইল ফোনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি খাতে অগ্রাধিকার এখন সময়ের দাবি। প্রস্তাবিত বাজেটে দেশে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশ ঘটবে। আমরা আশা করি এ শিল্পের বিকাশ বেকারত্ব কমাতে ভূমিকা রাখবে। অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে প্রযুক্তি শিল্পের বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট সেবা। দেশেই তৈরি হচ্ছে মানসম্মত ফোরজি স্মার্ট ফোন। সুতরাং আমদানি নরিুৎসাহিত করার এটাই সময়।
উদ্যেক্তাদের মতে, যারা বছরের পর বছর শুধু আমদানি বা ট্রেড করে মুনাফা করছেন তারা দেশে কোনো বিনিয়োগ করছেন না। তারা শুধু নিজেদের লাভের চিন্তা করছেন। দেশকে কিছু দেয়ার কথা ভাবছেন না। এটা আর চলতে পারে না। তাদের উচিত মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপন করে উৎপাদনের এসে দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখা। তাই শুল্ক বাড়িয়ে মোবাইল ফোন আমদানি নিরুসাহিত করা সময়ের দাবি। প্রযুক্তিপণ্যের উৎপাদনকারী হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।