এক দলের অপেক্ষা দীর্ঘ ৫২ বছরের, সেই ১৯৬৬ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। আরেক দলের ২০ বছরের, শেষবার ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছিল ক্রোয়েশিয়া। আজকের ম্যাচটি তাই দু'দলের সামনেই ইতিহাস ভাঙাগড়ার এক চ্যালেঞ্জ। ক্রোয়াটরা চাইবে তাদের অতীত ইতিহাস ভেঙে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে। আর ইংলিশ সিংহরা চাইবে ছেষট্টির সেই সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে। ধারে ও ভারে দু'দলই বেশ শক্তিশালী।
খেলোয়াড়দের বাইরে দু'দলের কোচদেরও নিজেদের প্রমাণ করার ম্যাচ। ক্রোয়েশিয়ার জল্গাতকো দালিচ আর ইংল্যান্ডের গ্যারেথ সাউথগেট- বিশ্বকাপ শুরুর আগে এ দুই কোচের কেউই হয়তো দলকে নিয়ে এতদূর আসার কথা ভাবতে পারেননি। কিন্তু অভাবনীয় পারফরম্যান্স দেখিয়ে ঠিকই বিশ্বকাপের শেষ চারে নাম লিখিয়েছে দালিচের ক্রোয়েশিয়া আর সাউথগেটের ইংল্যান্ড। আজ রাত ১২টায় মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে একে অন্যের মুখোমুখি হবে এ দু'দল।
দু'দলের জন্যই সেমিফাইনাল একটা বিশেষ মঞ্চ। ১৯৯৮ সালের পর এই প্রথম শেষ চার নিশ্চিত করেছে ক্রোয়াটরা। ইংল্যান্ডকে অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও বেশি সময়। ২৮ বছর পর ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে নামবে তারা। দু'দলের মধ্যে শেষ চারের পথটায় বেশি ঘাম ঝরিয়েছে ক্রোয়াটরাই। শেষ ষোলোতে ডেনমার্ক ও কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়া- দুই প্রতিপক্ষকেই তারা হারিয়েছে পেনাল্টি শুটআউটে। অন্যদিকে, কলম্বিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচে শুটআউটে জিতলেও কোয়ার্টার ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে ২-০ গোলের সহজ জয় পেয়েছিল তারা।
যে শুটআউট ক্রোয়াটদের স্নায়ুশক্তির পরিচয় দিচ্ছে, সেটাই আবার তাদের সামনে কিছু প্রশ্নবোধক চিহ্নও দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। প্রথমত, ডেনমার্ক ও রাশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের খেলাটাই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যথেষ্ট হবে কি-না। কারণ, ধারেভারে ওই দু'দলের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে ইংল্যান্ড। অন্যদিকে, দুটি পেনাল্টি শুটআউটে দলের জয়ের নায়ক গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচ রাশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়েছিলেন। পায়ে চোট নিয়েই টাইব্রেকারে দাঁড়িয়েছিলেন গোলবারের নিচে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তাই পুরোপুরি ফিট সুবাসিচকে পাওয়া নিয়ে একটা সংশয়ও থেকে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া শিবিরে।
ইংল্যান্ড দলে অবশ্য চোটের সমস্যা নেই। তবে ক্রোয়াটদের আক্রমণভাগের মূল ভরসা লুকা মডরিচকে যতটা সম্ভব নিষ্ফ্ক্রিয় রাখতে নিজ দলের খেলায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারেন ইংলিশ কোচ সাউথগেট। সে ক্ষেত্রে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ত্রয়ী জেসে লিনগার্ড, রহিম স্টার্লিং ও ডেলে আলির সমন্বয় ভেঙে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলানো হতে পারে এরিক ডায়ারকে। 'উইনিং কম্বিনেশন' ভাঙার এই জুয়া সাউথগেট খেলবেন কি-না, সেটা জানা যাবে ম্যাচের একাদশ ঘোষণার পরই।
পারফরম্যান্স আর পরিসংখ্যান- দুই জায়গাতেই ইংল্যান্ডের শক্তির জায়গা সেট পিস। এবারের বিশ্বকাপে তাদের করা ১১ গোলের আটটিই এসেছে সেট পিস থেকে। ১৯৬৬ সালে পর্তুগালের পর এক বিশ্বকাপে সেট পিস থেকে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড এটি। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে সর্বশেষ ৩০ ম্যাচের মাত্র দুটিতে হেরেছে ইংল্যান্ড। সঙ্গে এবারের বিশ্বকাপে তাদের অভাবনীয় সাফল্য যোগ করুন। দেখবেন, এই ইংল্যান্ড আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর।
তবে এগুলোর চেয়ে ইংলিশদের অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে আরেকটি পরিসংখ্যান। এবারের বিশ্বকাপে কর্নার থেকে এখন পর্যন্ত চারটি গোল পেয়েছে ইংল্যান্ড। সর্বশেষ যে তিনটি দল বিশ্বকাপের এক আসরে কর্নার থেকে চার বা তার বেশি গোল পেয়েছিল, শিরোপা উঠেছিল তাদের হাতেই- ২০১৪ সালে জার্মানি, ২০০৬ সালে ইতালি ও ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স।
ক্রোয়েশিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি অবশ্যই ইংলিশ স্ট্রাইকার হ্যারি কেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত চার ম্যাচ খেলে ছয় গোল করেছেন তিনি- গোল্ডেন বুট জয়ের দৌড়ে আছেন সবার আগে। যদিও ক্রোয়েশিয়া কোচ দালিচের বিশ্বাস, গ্রুপ পর্বে দলের ডিফেন্ডাররা যেহেতু লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়কে আটকাতে পেরেছে, তাই কেনকে আটকানো সমস্যা হবে না। সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, 'কেন গোল স্কোরার হিসেবে অসাধারণ। তাকে থামানোটা সহজ নয়। তবে আমাদের সেন্টারব্যাকরাও অসাধারণ। গ্রুপ পর্বে মেসি এবং শেষ ষোলোতে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের মতো ফুটবলারকে আমরা আটকে রেখেছিলাম। আশা করি, কেনকেও আমরা আটকাতে পারব। আমাদের নিজেদের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।'
কিন্তু এখানেও চলে আসছে আরেকটি প্রশ্ন। ছয় দিনের ব্যবধানে দুই ম্যাচে মোট ২৪০ মিনিট ফুটবল খেলেছে ক্রোয়াটরা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমির লড়াইয়ে তাই সব খেলোয়াড় কি শতভাগ সতেজ হয়ে নামতে পারবেন? নিশ্চিত করার দায়িত্ব দালিচের কাঁধেই।
নব্বই দশকের শুরুতে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা লাভের পর এখন পর্যন্ত সাতবার মুখোমুখি হয়েছে দু'দল। এবারের আগে বড় কোনো আসরে এ দু'দল লড়েছিল একবারই, ২০০৪ ইউরোর সেই ম্যাচে ইংলিশরা জিতেছিল ৪-২ ব্যবধানে। সেটার প্রতিশোধও পরে নিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। ২০০৭ সালের নভেম্বরে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে হারিয়েছিল তারা। আর সেই হারের ফলেই ২০০৮ ইউরোতে অংশ নেওয়া হয়নি ইংল্যান্ডের। দু'দলের শেষ দুটি দেখায় অবশ্য বড় ব্যবধানের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল ইংলিশরা, ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়েছিল ৪-১ ও ৫-১ ব্যবধানে।
ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তাই পরিসংখ্যান বা সাম্প্রতিক ফল, সবকিছুকেই আত্মবিশ্বাসের উৎস বানাতে পারে ইংলিশরা। আর ক্রোয়েশিয়ার অনুপ্রেরণায় থাকবে পেনাল্টি শুটআউটের দুটি জয় আর স্নায়ুশক্তি। সেইসঙ্গে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে পাওয়া সেই জয়ও।