বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তিত শিল্প উদ্যোক্তারা
প্রকাশ: ২০১৫-১১-০১ ১৩:৩৬:২২
‘কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বসে আছি। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছি না। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আমরা জানি না কয়েক বছর পরে কী হবে?’ সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় অনেক হতাশা নিয়ে এসব কথা বলেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের পরিচালক হোসেন খালেদ। সাথে সাথে তিনি বলে এসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত শিল্প উদ্যোক্তারা।
বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় দেশের আরো কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে। তাদের সবই কথা বলেন প্রায় একই সুরে। বিনিয়োগ নিয়ে শিল্প উদ্যোক্তারা বেশ চিন্তিত বলে জানান তারা। বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত।
তাদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় তাদের বিনিয়োগ সাফল্য নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেওয়া গ্যাসের দাম শতভাগ বাড়ানোর কারণে এর ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ড ও তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় এমনিতেই দেশের ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে। এর ওপর জানুয়ারিতে আবারও রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা বিরাজ করছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএফসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এতে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান দেখানো হয়েছে ১৭৪, যা গত বছর ছিল ১৭২। এই বার্তাটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেবে। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
আলাপচারিতায় ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি ও উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগ করে বসে আছি। নানা প্রতিবন্ধকতায় তা আর চালাতে পারছি না। বিশেষ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট আমাদের বেশি উৎকণ্ঠায় ফেলছে। আমরা জানি না ১০-১২ বছর পর কী হবে।’
সামনে কঠিন দিন আসছে উল্লেখ করে সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘১৫ বছর পর দেশের গ্যাস একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর দুই-চার বছর পর থেকেই বিভিন্ন কূপে গ্যাস কমতে শুরু করবে।’
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর এক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘বর্তমানে ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎই আসছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। কিন্তু এই গ্যাস যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন কীভাবে এই বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে, তার কোনো স্বচ্ছ ধারণা আমাদের সামনে নেই। ফলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। আবার আমরা বিনিয়োগ করে মহাবিপদে পড়েছি।’
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হোসেন খালেদ বলেন, ‘সবাই চায় একটি স্থিতিশীল পরিবেশ। দেশের পরিস্থিতি যে রকমই থাকুক আমরা ব্যবসায়ীরা সব সময়ই চাই দেশে বিনিয়োগ করতে। ব্যাংকগুলোও টাকা নিয়ে বসে আছে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুতের জন্য তো আমরা বিনিয়োগ করতে পারছি না।’
দেশি উদ্যোক্তা কমার সঙ্গে দিন দিন বিদেশি বিনিয়োগকারীও কমছে বলে তথ্য মেলে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে। বিনিয়োগ বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ১২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকার। এপ্রিলে বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ১৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকার। এরপর ব্যাপকভাবে কমতে থাকে বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ। মে মাসে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ৯ হাজার ৬ কোটি টাকার। জুনে তা আরো কমে ৭ হাজার ৭৪২ কোটি টাকায় নেমে আসে। এরপর জুলাইয়ে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ৩ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার। আগস্টে বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।
বিভিন্ন ব্যাংকের নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণে সুদের হার কমানোর পরও উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। বিনিয়োগ পরিবেশের আরো উন্নতি হলেই তাদের এ সংকট কেটে যাবে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ঋণের সুদ কমানোর পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হলে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হবে। আর এ কাজকে সরকারের সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, বিনিয়োগ না হলে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন সম্ভব নয়।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস