নগরে প্রতি বছর মানুষ বাড়ছে গড়ে ৩ শতাংশের উপরে। আর ঢাকা মহানগরীতেই প্রতি বছর নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে ৫ শতাংশের মতো। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশের আবাস এ নগরী। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঞ্চালক হওয়ায় মোট কর্মসংস্থানেরও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখানে। বিপুল এ চাপ সামলাতে নগর উন্নয়নে যে পরিকল্পনা দরকার, ঢাকার ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। প্রশস্ত সড়ক নেই। খোলা জায়গা কিংবা খেলার মাঠেরও অভাব। অবকাঠামোকেন্দ্রিক উন্নয়নে উপেক্ষিত পরিবেশ-প্রতিবেশ। জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করে গড়ে উঠছে আবাসন ও শিল্প।
ঢাকার মতোই নগর উন্নয়নের মডেল দেশের অন্য সব মহানগরীরও। কোনো ধরনের মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই হচ্ছে নগরের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। পৌরসভাগুলোয় একদিনের জাতীয় কর্মশালা করেই ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানের (সিআইপি) মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। যদিও নগর উন্নয়নে তিন দফা পরিকল্পনা ও নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তাতে বলা আছে পরিকল্পিত নগরের রূপরেখা। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।
সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া সুপরিকল্পিত নগর গড়া সম্ভব নয় বলে জানান নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে অনেকটা পথ চলে এসেছি। তার পরও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আসতে পারিনি। নগর উন্নয়ন নীতিমালা দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় আটকে আছে। রাজউকের একটি মহাপরিকল্পনার খসড়াও মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। এখন পর্যন্ত সেটিরও কোনো অনুমোদন হয়নি। ফলে অপরিকল্পিত একটি নগরীতে যা হয়, এখানেও তাই হচ্ছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বাজারের চাহিদা ও বিশ্বায়নের প্রভাবে রাজধানীমুখী মানুষের চাপ প্রতি বছরই বাড়ছে। রাজধানীতে বাস করছে দুই কোটির বেশি মানুষ। মাত্র ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তারা বাস করছে। এ বিপুলসংখ্যক মানুষের চলাচলে কোনো অঞ্চলেই সঠিক পরিকল্পনায় ফুটপাত হয়নি। পর্যাপ্ত সড়কও নেই। অপর্যাপ্ত সড়কে অস্বাভাবিক গাড়ির চাপে এক দশকে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে নেমে এসেছে মাত্র সাত কিলোমিটারে।
নগরীতে যানজট নিরসনে শুরুর দিককার উদ্যোগ ফুট ওভারব্রিজ। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় এরই মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ৬৬টি ফুট ওভারব্রিজ। কিন্তু সঠিক স্থানে না হওয়ায় পথচারীরা সেভাবে ব্যবহার করছে না তা। ফুট ওভারব্রিজের পাশাপাশি রয়েছে তিনটি আন্ডারপাস। এর মধ্যে একটি আন্ডারপাস দিয়ে পথচারী পারাপার চললেও অন্য দুটি কাজে আসছে না।
পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা। ঢাকার উন্নয়নে কাজ করছে সরকারের আট মন্ত্রণালয়ের ২৬টি বিভাগ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সমন্বয়ের বড় ধরনের ঘাটতি। ফলে জলাবদ্ধতা, যানজট ও অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ঢাকাবাসী।
বন্যা, জলাবদ্ধতা, যানজট ও অব্যবস্থাপনাকে বৃহত্তর ঢাকার তিনটি প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, আট মন্ত্রণালয়ের ২৬টি বিভাগ বা সংস্থা এ তিন সমস্যা সমাধানে কোনো না কোনোভাবে দায়িত্ব পালন করছে। নগর উন্নয়নে এসব বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকা বা কম থাকার কারণে সমস্যাগুলো থেকে স্থায়ী কোনো সমাধান পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অপরিকল্পিত উন্নয়নের ছাপ দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মহানগরী চট্টগ্রামেও। নগরীতে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি উড়ালসড়ক ও একটি ওভারপাস নির্মাণ হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিটি আউটার রিং রোড ও জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের কাজও চলছে। ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকায় লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে। এর বাইরে গত কয়েক বছরে শত শত কোটি টাকায় আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন উন্নয়নের কারণে এসব প্রকল্পের সুফল মিলবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান নগর পরিকল্পনাবিদরা।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, পরিকল্পনাকে অগ্রাহ্য করে নগরে যে যার মতো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মাঠ তৈরি না করেই একেকটি প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ টাকা কারা পাবে, সেটিও ঠিক করা থাকে। এসব প্রকল্প আদি পরিকল্পনা গ্রন্থে আছে কিনা, তা কেউ দেখছেন না। এখন যেভাবে উন্নয়নের নামে টাকা ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে, অপরিকল্পিত হওয়ায় তা জলে যাবে।
তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) যে উড়ালসড়কগুলো নির্মাণ করছে, তা কি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ছিল? জনগণের কল্যাণের জন্য নয়। বাহবা কুড়ানো ও প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য বড় বড় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। হাজার কোটি টাকার ফ্লাইওভারে দিনে হাজারটা গাড়িও ওঠে না।
পরিকল্পনামাফিক উন্নয়ন হচ্ছে না দেশের প্রায় কোনো পৌরসভারই। যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই। অনেক পৌরসভায় অতি দুর্বল মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও তার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক শ্রেণীতে পৌরসভার ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা না থাকায় ও পরিকল্পনাবিদদের কাজে না লাগানোসহ তাদের কাজের ক্ষেত্র কমানোর কারণে সার্বিকভাবে পরিকল্পিত নগরায়ণ করা সম্ভব হচ্ছে না। নীতিমালা না থাকায় অনেক সময় ড্রেন, রাস্তা, স্থাপনা নির্মাণসহ নানা কাজে পরিকল্পনাবিদদের যুক্ত না করেই এসব কাজ সম্পাদন করা হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (প্ল্যানিং) ইফতেখার আহমেদ বলেন, নগর উন্নয়নে নীতিমালাটি খুবই জরুরি। কারণ বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেই নগর নীতিমালা রয়েছে। সেই নীতিমালা ধরেই ওইসব দেশের নগরের উন্নয়ন করা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সে নীতিমালা না থাকার পরও আমরা চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব ত্রুটিমুক্তভাবে কাজ করার। তার পরও কিছু জায়গায় পরবর্তী সময়ে ত্রুটি দেখা দেয়। মোটকথা ত্রুটিমুক্ত নগর গড়তে হলে উন্নয়ন নীতিমালার বিকল্প নেই।
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ সিটি করপোরেশনেই নগর পরিকল্পনাবিদ রয়েছেন। কিন্তু নীতিমালা না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের মতামত নেয়া হচ্ছে না। এমনকি খোদ ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনেই (ডিএনসিসি) কোনো নগর পরিকল্পনাবিদ নেই।
সূত্র বণিক বার্তা