চলতি অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ লক্ষ্য পূরণে কোনো কোনো অধিক্ষেত্রকে বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি রাজস্ব আহরণ করতে হবে। যদিও এ লক্ষ্য অর্জনে অপারগতা প্রকাশ করছে মাঠ পর্যায়ের কমিশনারেট ও কর অঞ্চলগুলো। এনবিআরে চিঠি দিয়ে এ অপারগতার কথা জানিয়েও দিচ্ছে তারা।
রাজস্ব আহরণে বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় ৫১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দেয়ায় তা অর্জন সম্ভব নয় জানিয়ে এরই মধ্যে এনবিআরে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা উত্তর।
এনবিআরের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা উত্তরের কমিশনার জাকিয়া সুলতানা বলেন, মূসকের ক্ষেত্রে এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগ থেকে আমাদের জন্য ১০ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সাময়িক আদায়ের চেয়ে ৫১ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। তবে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির জন্য এ অধিক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর কোনো নতুন খাত যুক্ত হয়নি। অন্যদিকে নতুন স্থাপিত সিগারেট, এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ও ইলেকট্রনিকসহ কয়েকটি শিল্প খাতে রেয়াত সুবিধা দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে রাজস্ব আহরণ কমে যাবে। ফলে এ অধিক্ষেত্রের জন্য চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমানোর বিশেষ অনুরোধ করছি।
তবে কোনো কোনো কমিশনারেটের জন্য ৮৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রাও আছে। এসব অধিক্ষেত্রও অপারগতার কথা জানিয়ে চিঠি পাঠানোর কথা ভাবছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বড় ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হলেও করের পরিধি খুব একটা বাড়ানো হয়নি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে। দেশীয় শিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রে করছাড় দিলেও ব্যয় নির্বাহে বড় অংকের রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে এনবিআরকে। বিশাল এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে মাঠ পর্যায়ের কমিশনারেট ও কর অঞ্চলগুলোর জন্য অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এনবিআর।
এনবিআরের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি অর্থবছরই আগের অর্থবছরের তুলনায় রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ে। তা অর্জনে করের পরিধি বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ তৈরি করে দেয়া হয়। চলতি অর্থবছরটি নির্বাচনী বছর হওয়ায় করের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে। বাজেটে ব্যয়ের পরিধি বাড়ানোর কারণে এনবিআরকে অতিরিক্ত কর আহরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে এনবিআরও মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোকে বড় লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জন্য মূল্য সংযোজন করের ক্ষেত্রে বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল এনবিআর। তবে গত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রকৃত আদায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা কম হওয়ায় তা ৪১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ফলে কমিশনারেটগুলোর জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদায়ী অর্থবছরের প্রকৃত আদায়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, কুমিল্লার জন্য। বিদায়ী অর্থবছর ২ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা আদায়কারী অধিক্ষেত্রটির জন্য চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা; যাতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, যশোরের জন্য। রাজশাহী কমিশনারেটের জন্য দেয়া হয়েছে ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা।
ভ্যাট খাতে এনবিআরের রাজস্বের মূল জোগানদাতা বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। বিদায়ী অর্থবছরে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেলেও চলতি অর্থবছর তাদের জন্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা থাকছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছর এলটিইউর ৪৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের বিপরীতে চলতি অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকা। ভ্যাটের দ্বিতীয় বৃহৎ জোগানদাতা চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের জন্য চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দেয়া হয়েছে ৪৪ শতাংশ। ৪০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দেয়া অন্য কমিশনারেটগুলোর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের জন্য তা ৪৩ দশমিক ৫২, ঢাকা পশ্চিম কমিশনারেটের ৪৪ ও খুলনা-সিলেট কমিশনারেটের জন্য ৪০ শতাংশ।
রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা সক্ষমতার নিরিখে বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যৌক্তিক। এর বেশি হলে তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। উচ্চাভিলাষী বাজেট সমন্বয়ের জন্যই রাজস্ব আহরণে অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। তবে অর্থবছর শেষে বাজেট বাস্তবায়নের হার কমে যাওয়ায় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও কমবে।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকাকে ভিত্তি ধরে চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আহরণে এনবিআরকে ২ লাখ ৯১ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। এতে প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে বিদায়ী অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে প্রকৃত আদায় লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা কম হওয়ায় এখন প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ।