পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থা, বাজারের উন্নতি কিংবা ভবিষ্যত সম্ভাবনাসহ নানা বিষয়ে সানবিডি সঙ্গে কথা বলেছেন, এএফসি ক্যপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, মাহবুব এইচ মজুমদার। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।
পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থা
পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে হলে দুইভাবে করতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে, সেকেন্ডারি মার্কেটের গতিবিধি পর্যালোচনা। বর্তমানে সেকেন্ডারি মার্কেটে ১ হাজার কোটি টাকার আশে পাশে টার্নওভার হচ্ছে। আমার মতে এটা খুবই কম। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকার আশে পাশে টার্ন ওভার হওয়া উচিত ছিল। স্বাভাবিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করলেই বর্তমান টার্নওভারের চিত্রটি স্পষ্ট বোঝা যাবে। আর দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, সূচক। সূচকের কথা বলতে গেলে সেটাও অবমূল্যায়িত হয়ে আছে। এখন ৫৮৭৫/৭৬-এর ঘরে আছে। এটা আরো অনেক বেশি হওয়া উচিত। গত ৫/৭ বছরে প্রায় ৯৫/৯৬টা কোম্পানি যোগ হয়েছে। স্টক ডিভিডেন্ট আসছে। সে হিসেবে সূচক অনেক কম। গত ৫ বছরের রাইট ইস্যুগুলো যোগ করলেই এসব স্পষ্ট বোঝা যাবে। এবার বলি মার্কেটের রিস্ক ফ্যাক্টরের কথা। মার্কেটকের রিস্ক ফ্যাক্টর এনালাইসিস করার জন্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড থামরুল যে পি-রেসিও রয়েছে সেটাও কিন্তু আমাদের মার্কেটে অনেক কম। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে পি-রেসিও ১৭ চলছে। কিন্তু আমাদের মার্কেটে পি-রেসিও ১৭ এর নীচে।
আর মার্কেট অনেক দূর যাবে বলে যে কথা শোনা যাচ্ছে এটা অবশ্যই সম্ভাবনাময়। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের মার্কেট আরও অনেক বড় হওয়ার কথা ছিল।
২০১০ সালে মার্কেট ক্যাপিটাল আর জিডিপি’র অনুপাত ছিল ৫০ শতাশং। অর্থাৎ জিডিপির অর্ধেক ছিল মার্কেট ক্যাপ:। আর বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপি গ্রোথের সঙ্গে আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেট ম্যাচ করতে পারছে না। আমি বলব, ৫০ শতাংশ থেকে কমে গত ৭/৮ বছরে ১৯ শতাংশে চলে আসা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বিদেশি বিনিয়োগ কিন্তু অন্যান্য সেক্টরে তেমন আসছে না। শুধুমাত্র আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে অন্য যে কোনো সেক্টর থেকে অনেকগুণ বেশি আসছে। বুঝতে হবে বিদেশিরা কখন বিনিয়োগ করে? তারা হাজার হাজার ফ্যাক্টরি এনালাইসিস করে সবুজ সংকেত পেলেই তবে তারা বিনিয়োগ করে। এ থেকে বোঝা যায় আমাদের দেশের অধিকাংশ ফ্যাক্টরি পজিটিভ সিগন্যাল শো করছে। সব মিলিয়ে আশা করাই যায় মার্কেটে গতি শুরু হয়েছে। এটি অনেক দূর যাবে।
ভালো মার্কেট পেতে করণীয়
ভালো মার্কেট পেতে সর্বপ্রথম দরকার ভালো স্ক্রিপ্ট এবং বহুসংখ্যক স্ক্রিপ্টের। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে ১০টি কাজ করতে গেলে একটি খারাপ কাজ হতেই পারে। কিন্তু কাজ না করলে কিছুই হবে না। এখন যদি আমরা বেশি সংখ্যক আইপিও না দিই; মার্কেটের গভীরতা যদি না বাড়ে তবে এই অল্প সংখ্যক স্ক্রিপ্টের মধ্যেই কারসাজি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এজন্য অবশ্যই বেশি করে আইপিও দিতে হবে। আর এজন্য যা যা করা প্রয়োজন- আইন-কানুন বিবর্তন বা পরিবর্তন-পরিমার্জন সবই করতে হবে। এবং খুব দ্রুত গতিতে করতে হবে। ক্যাপিটাল মার্কেটে গতি একটা অন্যতম ফ্যাক্টর। এখানে সময়মত গুরুত্বসহ কাজ না করলে হবে না। লক্ষ্য রাখতে হবে কোন কোন সেক্টরের আইপিও আনা যায়। এবং ওই সকল সেক্টরের আইপিও আনতে যে সকল আইনি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করতে হবে। যেমন সরকারি শেয়ার অফলোডের চিত্র থেকে দেখা যায় গত ৫/৭ বছরে অনেক ধরনের আলোচনা হলেও একটি কোম্পানিকেও পুঁজিবাজারে আনা যায়নি। যদিও এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই । অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই চাচ্ছেন বাজারে শেয়ার আসুক। একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, সরকার কেন ব্যবসা করবে? সরকার ব্যবসা সহায়ক ক্ষেত্র তৈরি করবে। সরকার ট্যাক্স কালেকশন করবে। যদি আমি মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলি- এখানে সমস্ত কোম্পানি ব্যক্তি মালিকানায় দিতে হবে। সরকার শুধু সহায়ক শক্তি হবে। তারপর যেগুলো সরকারের হাতে আছে সেগুলোও ছাড়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এত আলোচনার পরও সমাধান হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যুরোক্রেসি। সবার আগে এই ব্যুরোক্রেসির চক্র ভাঙতে হবে। ব্যুরোক্রেসির বাধা ভাঙার জন্য যতগুলো ইস্যু রয়েছে এগুলোর জন্য আইসিবিকে ইস্যু ম্যানেজার করতে হবে। আর আিিইসবি’র ইস্যু ম্যানেজ করতে হলে অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই করতে হবে। যদি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে দেওয়া হয় তাহলে কাজের গতিশীলতা কমে যায়। এজন্য আমি মনে করি আইসিবি’র সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজনই নেই। মার্চেন্টম্যান যারা থাকবেন তারা নিজ উদ্যোগে কাজ করবেন। আবার কিছু সুবিধাবাদী মহল রয়েছে তারা কোনোভাবেই চাচ্ছে না যে কোম্পানিগুলো বাজারে আসুক। তারা নানা অনিয়ম করে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে ভালো কোম্পানিগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। এবং সরকার ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে। সরকারের এই যায়গা থেকে সরে আসতে হবে। সরকার কেন ব্যবসা করবে? এজন্য একটি কমিশন করাও জরুরি। এভাবে না করলে গত ৭/৮ বছরে যেমন একটি কোম্পানিও আনতে পারেনি। তেমনি আগামি ৭/৮ বছরেও আনতে পারবে না। যারা ক্যাপিটাল মার্কেট সম্পর্কে বোঝেন এবং আইন কানুন জানেন তাদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে।
কিছু লাভজনক কোম্পানি বাজারে এসেছে ঠিক তবে যে কোম্পানিগুলো লোকসানের কারণে আসতে পারছে না তাদের কথাও চিন্তা করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ডিসকাউন্টে শেয়ার ছেড়ে দিতে হবে। এতে কিন্তু সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লস দিতে হবে না। আমরা জানি ব্যাংকসহ অনেক কোম্পানি ও সংস্থার মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের হাজার হাাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সরকারি কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হলে এত ভর্তুকি দিতে হবে না। আর এজন্য অবশ্যই কমিশন করতে হবে। এটা হতে পারে ৫ বছর বা ৩ বছর বা ১০ বছরের জন্য। অথবা যতদিন পর্যন্ত সকল কোম্পানি পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত না হবে ততদিনের জন্য। এই উদ্যোগটা যদি ৫ বছর আগে নেওয়া হতো তাহলে এতদিন ৫০টি কোম্পানি বাজারে চলে আসত।
বহুজাতিক কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়ে
বাংলাদেশে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি বেশ লাভজনকভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে অথক হাতে গোনা কয়েকটি বাদে অন্যরা পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবুও তারা আসেনি। এখন তাদের আনতে হলে একটাই উপায়, আর তা হচ্ছে উপযুক্ত আইন করা। আইন ছাড়া তো কাউকে বাজারে আসতে বাধ্য করা যায় না। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সেটা সমর্থন করে না। তাই এমন আইন করতে হবে যেন তারা বাজারে আসতে উৎসাহী হয়। আবার এটিও মাথায় রাখতে হবে কিছু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আমাদের দেশের স্বার্থের জন্যেই জরুরি। এগুলোকে ৫ বছরের সময় দেওয়া যেতে পারে। আগে একটা আইন ছিল- যদি ৫০ কোটি টাকা পেইড আপ ক্যাপিটাল হয় তাদের বাধ্যতামূলক পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। কিন্তু কি কারণে জানি না, গত ২ বছর আগে মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তা থেকে কোম্পানিগুলোকে অব্যাহতি দিয়েছে। অথচ এখানে হওয়া উচিত ছিল পেইড ক্যাপিটাল ৫০ কোটি টাকার উপরে হওয়ার পরেও যারা পুঁজিবাজারে আসবে না তাদের জন্য অতিরিক্ত একটা ট্যাক্স ধার্য করা। অথচ করা হলো উল্টো। আসলে বছরের পর বছর তারা ব্যবসা করবে অথচ পুঁজিবাজারে আসবে না সেটা হয় না। এটা পৃথিবীর কোনো দেশে সম্ভব নয়। শুধু আমাদের দেশে কী কারণে যে এমনটি করা হলো জানি না। আমি মনে করি এটাও অনুসন্ধান করা উচিত। মাল্টিন্যাশনাল ও জয়েন্ট ভেঞ্চার মিলিয়ে প্রায় ৪০০ কোম্পানি আছে। যার মধ্যে মাত্র ১৩টি কোম্পানি লিস্টেড। এরমধ্যে আবার কিছু কোম্পানি আছে যাদের মাত্র ৫% শেয়ার অফ্রোড করা। এটা করেছে শুধুমাত্র ট্যাক্স বেনিফিটটা নেওয়ার জন্য। অর্থাৎ এদেশের টাকা আইনগতভাবেই বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
দেশীয় অনেক ভালো কোম্পানিও পুঁজিবাজারে আসছে না
আমাদের দেশেরও অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা ভালো অবস্থানে থেকেও পুঁজিবাজারে আসছে না। এটা তাদের জন্যই ক্ষতিকর। বর্তমানে যারা ভালো অবস্থানে আছে পাঁচ বছর পর তারা ভালো অবস্থানে নাও থাকতে পারে। অনেক কোম্পানি আছে যারা ৫০বছর আগে বেশ ভালো অবস্থানে ছিল এখন নেই। কিন্তু তারা যদি ক্যাপিটাল মার্কেটে লিস্টেড থাকতো তাহলে তাদের একটি কর্পোরেট গভর্নন্যান্স দাঁড়ায়। কোম্পানি নিজস্ব গতিতে চলে। ভালো ভালো লোকজন রাখা যায়। ক্যাপিটাল মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হলে অনেক ভালো ভালো উদ্যোক্তা আসবে। এতে কোম্পানির দুঃসময়েও উদ্যোগীরা এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর যদি ব্যক্তি মালিকানায় বন্দি করে রাখা হয় তবে কোম্পানি কোনোভাবে পড়ে যেতেই পারে। এজন্য বলি বড় বড় কোম্পানিগুলো বাজারে আসার প্রসেস তৈরি করতে হবে। বসুন্ধরা গ্রুপ আছে, যমুনা গ্রুপ, স্কয়ারের কিছু কোম্পানি রয়েছে; এদের আসতে হবে। প্রয়োজনে আইনের কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। মোট কথা, এই কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা না হলে ওইসব কোম্পানিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে। আর ভালো একটি কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে আল্টিমেটলি দেশেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
কর বৈষম্য
ট্যাক্সের বিষয়টা হওয়া উচিত ছিল সেক্টরভিত্তিক। যদি ব্যাক টু ব্যাক এলসির ফ্যাসিলিটি দেওয়া না হতো তাহলে আমাদের দেশে আজ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আসত না। আমাদের দেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আসার অন্যতম কারণ ছিল সরকারের উচ্চ মহলের যুগোপযোগী পদক্ষেপ। যার ফলে আজ এত বড় বড় গার্মেন্টস তৈরি হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তিদের সুবিধা দেখা না হলে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ট্যাক্সের ক্ষেত্রে বৈষম্য কিন্তু আস্থাহীনতা তৈরি করে। মার্চেন্টব্যাংককে তাদের আয়ের ৩৫ বা ৩৭ পার্সেন্ট ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। অথচ অন্যান্যদের অনেক কম দিতে হচ্ছে। এটা হওয়া উচিত নয়। সবার জন্য কর হার সমতার হওয়া উচিত। মার্চেন্টব্যাংক এসোসিয়েশন থেকে বারবার প্রস্তাবনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। আসলে এটি সম্পূর্ন অর্থমন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমরা আশা করছি অর্থমন্ত্রণালয়ে যারা আছেন তারা আমাদের এই বিষয়টি লক্ষ্য করবেন।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ
বিনিয়োগকারীদের প্রতি প্রথম অনুরোধ হচ্ছে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যে কার্যক্রম চালাচ্ছে এগুলো একটু ভালোভাবে জেনে নিবেন। এই বাজারে লাভ যেমন আছে তেমনি ঝুঁকিও আছে। এ বিষয়গুলো জেনে বুঝে আসতে হবে। যারা ইতোমধ্যে ইনভেস্ট করে ফেলেছেন তাদের বলি- নির্দিষ্ট স্টকে ইনভেস্ট করতে। যেন সেক্টর দেখে ইনভেস্ট না করে। আর ডিভিডেন্ট ট্রেন্ড লক্ষ্য করতে হবে। আর কোম্পানি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কমপক্ষে ৫ বছরের ডিভিডেন্ড ট্রেন্ড গুরুত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখবেন।