খেলাপি ও ঋণের সুদহার না কমলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০১৮-০৮-০১ ০৮:০০:৫৪
*ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণে নজরদারির দাবি
* অর্থ পাচারের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত
খেলাপি ও সুদের হার না কমলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সে কারণে ব্যাংকগুলো কী হারে আমানত সংগ্রহ করছে এবং কী হারে ঋণ দিচ্ছে, তা নজরদারির মধ্যে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা যেসব সুবিধা নিয়েছেন তাতে ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ কমাতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। মঙ্গলবার চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৮) মুদ্রানীতি ঘোষণায় এসব কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে বেলা সাড়ে ১১টায় মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়।
এ সময় ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, এসএম মনিরুজ্জামান, আহমেদ জামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেইঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার আল্লাহ মালিক কাজেমী, ব্যাংকিং রিফর্ম অ্যাডভাইজার এসকে সুর চৌধুরী, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. ফয়সল আহমদ, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মো. আখতারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক মাসুম কামাল ভূঁইয়া, আবদুর রহিম, এএনএম আবুল কাশেম, মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম, দেবাশিস চক্রবর্ত্তী, অশোক কুমার দে, আজিজুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বিনিয়োগ প্রশ্নে গভর্নর ফজলে কবির সাংবাদিকদের বলেন, খেলাপি ঋণজনিত ব্যয়ভারসহ ব্যাংকের সামগ্রিক পরিচালন ব্যয় কমিয়ে ঋণ ও আমানতের সুদের হার কমাতে হবে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার এবং এর সঙ্গে ট্রেজারি বন্ডের তুলনামূলক বাজার হার- এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।
ঘোষিত মুদ্রানীতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটি গতানুগতিক। এতে নতুন কিছু নেই। এ মুদ্রানীতি সর্বসাধারণের খুব বেশি কাজে আসবে না। রেমিটেন্স, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগসহ যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবেলায় ঘোষিত মুদ্রানীতি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সাবেক এই গভর্নর।
আমদানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, টাকা পাচার হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, চার হাজার কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধানে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তা পাঠিয়েছি। এ বিষয়ে আরও কাজ চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, বেনামি ও পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। বিভিন্ন পরিদর্শনে ওঠে আসা বেনামি ঋণখেলাপি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। আরও কোনো তথ্য থাকলে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেব। এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ভল্টে কাস্টমসের কর্মকর্তাদের রাখা স্বর্ণে কোনো হেরফের হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট খুবই সুরক্ষিত। ছয় স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তার মধ্যে ৪২টি সিসিটিভি রয়েছে।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় লিখিত বক্তব্যে গভর্নর বলেন, আগের ধারাবাহিকতায় প্রবৃদ্ধিবান্ধব ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে এবারের মুদ্রানীতির ভঙ্গি সংযত ধরনের থাকবে।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এই হার গত মুদ্রানীতিতেও একই ছিল। সরকারি ঋণের প্রাক্কলন করা হয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, যা জানুয়ারি-জুলাই মেয়াদের মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশের চেয়ে একটু বেশি। ব্যাপক মুদ্রার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১২ শতাংশ।
গভর্নর বলেন, অভ্যন্তরীণ ঋণের ব্যবহার যেন বিলাসী এবং অপ্রয়োজনীয় খাতে না যায়, সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনমুখী এবং কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি যদিও গতবারের মুদ্রানীতির মতো ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে, কিন্তু সরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের চাহিদা কম থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ থাকবে।
মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নগদ জমা রাখার হার অনুপাত বা সিআরআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তহবিল আহরণের (রেপো) সুদের হারও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
বর্তমানে সিআরআর আছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। রেপো সুদের হার ৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর অর্থ সংকট কাটাতে গত এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত সিআরআর ও রেপোর হার কমিয়ে আনে।
গভর্নর বলেন, আগের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, তা অর্জিত হয়নি। এ বছরের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ জন্যই মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সংযত মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য ধরেছে, তা বাস্তবায়নে সহায়তা করতেই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
গত অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার আশা করা করা হয়েছিল। অর্থবছর শেষে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস। আর পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
সরকার চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার আশা করছে। বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের ঘোষিত আর্থিক নীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে প্রতি অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঘোষিত মুদ্রানীতি কেমন হয়েছে- জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কিছুটা সংকোচন মূলক। তবে এটি যথার্থ। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এমনটি দরকার ছিল।