আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কিনে নিচ্ছে জাপানি কোম্পানি জাপান টোব্যাকো আইএনসি (জেটিআই)। এ অধিগ্রহণে জেটিআইয়ের ব্যয় হচ্ছে আনুমানিক ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। গতকাল এ-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত কোনো বিদেশী কোম্পানির বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ অধিগ্রহণ।
জানা গেছে, অধিগ্রহণ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ নাম আর থাকছে না। অধিগ্রহণকৃত নতুন কোম্পানির নাম ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড (ইউডিটিসি)। বাংলাদেশে সিগারেটের বাজারের ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ঢাকা টোব্যাকো। ঢাকা টোব্যাকোর সিগারেটের ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নেভি ও শেখ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সর্ববৃহৎ অধিগ্রহণ বলে জানান বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম. আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ অধিগ্রহণ যেনতেন দেশ থেকে নয়, এটি হচ্ছে জাপানের সঙ্গে। বাংলাদেশে বিদেশী বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আসে। তাদের অনেকে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া প্রকল্পগুলোয় ঠিকাদার বা অন্যান্য ভূমিকায় কাজ করে। এটিই একমাত্র প্রকল্প বাংলাদেশে, যেটা প্রকৃত অর্থেই বেসরকারি খাতের মধ্যকার একটি ঘটনা। এ চুক্তির কাঠামোটি অনেক জটিল ও বিস্তারিত। এটা থেকে বাংলাদেশের যে শিক্ষা হবে, সেটা দিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ অন্যান্য বড় চুক্তি করার অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। জেটিআই জাপানি প্রতিষ্ঠান হলেও এর মধ্যে আছে পশ্চিমা দেশের জনবল। প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে পশ্চিমা লোকবলই কাজ করেন। অর্থাৎ এ চুক্তির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের সম্মিলন হচ্ছে। করপোরেট সংস্কৃতির উত্তম চর্চাগুলো এর মাধ্যমে আমরা শিখতে পারব। মূল্য সংযোজনের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থানও হবে।
বিআইডিএর কোনো ভূমিকা এ অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে রয়েছে কিনা জানতে চাইলে কাজী এম. আমিনুল ইসলাম বলেন, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিআইডিএর ভূমিকা ছিল। জেটি প্রথমে বিআইডিএর কাছে এসেছে, যৌথ বিনিয়োগের বিষয়টি বলেছে। তারা ব্যবসার বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে আলোচনা করেছে। তারপর আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছে পরিকল্পনাটি তুলে ধরেছি। যেহেতু প্রথমবারের মতো এত বড় একটি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া, তাই নলেজ পার্টনার হিসেবে বিআইডিএ ভূমিকা পালন করেছে। চুক্তিটি সম্পন্নের জন্য যত ধরনের সহায়তা বিআইডিএর পক্ষ থেকে করা সম্ভব, তা করা হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিদেশীদের নিশ্চয়তার প্রতিফলন দেখা গেছে। সারা বিশ্বের কাছে এ ঘটনা কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রথমত. বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য প্রস্তুত, দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশের সম্ভাবনার ব্যাপ্তি অনেক বড়। এ ধরনের চুক্তির মাধ্যমে আর্থিক বিষয়ের চেয়েও এ সংকেতগুলোই বেশি গুরুত্ব রাখে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড কিছু সুনির্দিষ্ট সেবা দেবে। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমেই তারা এ কাজ করবে।
তেজগাঁওয়ে আকিজ গ্রুপের কার্যালয়ে গতকাল বেলা ১টার দিকে আকিজ গ্রুপ ও জেটির মধ্যে অধিগ্রহণসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকটি সই হয়। এ-সংক্রান্ত জেটির পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, জাপান টোব্যাকো গ্রুপ আকিজ গ্রুপের তামাক বিভাগ অধিগ্রহণের জন্য একটি চুক্তি সই করেছে। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন, গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বাশির উদ্দিন, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) শামসুদ্দিন আহমেদ, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের মহাব্যবস্থাপক ম্যাক্স লোভাচেভ, বিআইডিএর নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজি এম. আমিনুল ইসলাম ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয়।
জেটিআই সূত্রে জানা গেছে, অধিগ্রহণকৃত নতুন কোম্পানি ইউডিটিসির প্রধান কার্যালয় হবে তেজগাঁও-গুলশান সংযোগ সড়কের আকিজ হাউজ। এর প্রতিনিধিত্ব করবেন শেখ বশির উদ্দিন। প্রতিষ্ঠানটির মূল শেয়ারহোল্ডারের সংখ্যা পাঁচ।
নতুন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলা হয়েছে, এর নিট সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদের পরিমাণ ৬৪ হাজার টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। পরিচালন মুনাফা হবে ৪৭০ কোটি টাকা। জেটি গ্রুপের কন্ট্র্যাক্ট ম্যানুফ্যাকচারার ও ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করবে আকিজ। মোট ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকার মধ্যে সব শেয়ারের জন্য ৯ হাজার ১৮০ কোটি এবং ট্রেডমার্ক ও ডিজাইন স্বত্বের জন্য দেবে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
বিবৃতিতে আকিজ গ্রুপের তামাক বিভাগ অধিগ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন জেটিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ও সিইও এডি পিরার্ড। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। দেশটিতে আমাদের উপস্থিতি বাড়াতে আগ্রহী। আকিজ গ্রুপের তামাক বিভাগ লাভজনক। এর রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির উৎপাদন ব্যবস্থা, একটি শক্তিশালী ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক ও কর্মী বাহিনী। আমাদের শক্তিশালী রেকর্ডের সঙ্গে একত্র করে সুপ্রতিষ্ঠিত পোর্টফোলিওর পাশাপাশি আমরা আমাদের কার্যকরী দক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে পারি। আকিজের ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি আমাদের কিছু ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি।
টঙ্গীতে ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৭৮ সালে কিনে নেন আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন। সেই থেকে ধীরে ধীরে আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিগারেট বাজারের ২০ শতাংশ দখলে রয়েছে ঢাকা টোব্যাকোর।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানও এটি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরও ভ্যাটবাবদ ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছে ঢাকা টোব্যাকো।
জেটি গ্রুপের ব্যবসায়িক পদচারণা আছে ১৩০টি দেশে। ৬০ হাজার মানুষ কাজ করছে গ্রুপটিতে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জাপান টোব্যাকো বেসরকারি কোম্পানিতে রূপ নেয় ১৯৮১ সালে। এর বার্ষিক আয় ২ ট্রিলিয়ন ইয়েনেরও বেশি।