তিনি নিজেকে তেমন মনে করতেন না, যেমনটি আমরা সবাই তাকে জানতাম একজন মেধাবী সম্পাদক হিসেবে, অর্থ-বাণিজ্য-ব্যবসাবিষয়ক পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকা যার হাতে ধীমান ও সৃজনশীল হয়ে উঠেছিল, যিনি অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ বছরগুলো থেকে দেশের অর্থনীতির ওপর সুতীক্ষ চোখ রাখতেন, সৃজনশীল ভাবনা ও বিশ্লেষণে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসনকে সংহত ও সমন্বিতকরণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকতায় অর্ধশতাব্দীকাল তার সগৌরব পদচারণায় তিনি নিজেকে সবসময় প্রস্তুত রাখার, প্রয়োজনে নিজেকে ভাঙার, পরিবর্তন করার মানসিকতায় ছিলেন অয়োময় আদর্শের অধিকারী। তিনি সদ্যপ্রয়াত আমাদের সবার প্রিয় মোয়াজ্জেম ভাই, এএইচএম মোয়াজ্জেম হোসেন (১৯৪৮-২০১৮)। ভাই বলেই আমরা সবাই (তার অগ্রজ, অনুজ, সমবয়সী সবাই) তাকে জানতাম। আমার প্রতিবেশী ছিলেন শেষের দেড় দশক।
১৯৯২ সালে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা, প্রধান অধিকারিক এবং করণিকও ছিলেন বটে মোয়াজ্জেম ভাই। সেই সূত্রেই আমাদের প্রথম যোগাযোগ। আমি তখন ইআরডিতে বৈদেশিক সাহায্যের বাজেট ও হিসাব বিভাগের পরিচালক। ইনাম আহমেদ (বর্তমানে ডেইলি স্টারের বিজনেস বিভাগের প্রধান পুরোহিত) একদিন অনুরোধ করলেন ইআরএফের ক্লাস নিতে। আমি আশ্চর্য হয়ে জানলাম নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশের অর্থনীতি যখন প্রসারিত হতে সবে শুরু করেছে, তখন ইকোনমিক বিষয় নিয়ে যেসব সংবাদকর্মী লেখালেখি ও প্রদায়ক হিসেবে কাজ করেন, তাদের সংগঠন হিসেবে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম গড়ে উঠেছে। উদ্যোক্তা মোয়াজ্জেম ভাই। তাদের অন্যতম কর্মসূচি হচ্ছে প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অর্থনীতির ওপর কাজ করে যারা, তাদের জন্য পর্যালোচনা-প্রশিক্ষণ, কর্মশালার আয়োজন। কীভাবে সরকারি বাজেট প্রাক্কলিত হয়, প্রণীত হয়, অনুমোদিত হয়, সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা— এসব নিয়ে আমাকে কয়েকটা ক্লাস নিতে হবে। প্রস্তাব লুফে নিলাম। কেননা যারা রিপোর্ট লেখেন তারা যদি এ-বিষয়ক খুঁটিনাটি, এসবের মধ্যকার ঘোরপ্যাঁচ, টার্মিনোলজি জানেন ও বোঝেন তাহলে তাদের রিপোর্টটি অবশ্যই ভালো হবে, বিশ্লেষণাত্মক হবে, পাঠক উপকৃত হবেন, পলিসিমেকার পাবেন পুষ্টিকর পরামর্শ। সে সময় মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা ও পরিচয়। তিনি বিশ্বাস করতেন ভালো রিপোর্ট তার পক্ষে করা সহজতর, যার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান-অভিজ্ঞান যত বেশি। এসব প্রতিবেদকের ‘প্রফেশনাল’ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য চাই সাংগঠনিক, প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা ও প্রয়াস। এজন্য তাদের একটা প্লাটফর্ম প্রয়োজন। ইআরএফ সেই প্লাটফর্ম। এরপর গত তিন দশক ইআরএফের বহু কর্মশালায়, বিশেষ আয়োজনে বক্তৃতা দিয়েছি।
মূলত মোয়াজ্জেম ভাইয়ের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে, তার দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করেই আমি যখন এনবিআরের চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন সংবাদমাধ্যমকে রাজস্ব আহরণ পরিবেশ-পরিস্থিতি ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ার হালচাল সম্পর্কে জানাতে পাক্ষিক প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করতাম, আর এনবিআরের ওয়েব পেজকে সবসময় হালনাগাদ রাখা হতো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে। ২০০৭-০৯ সালে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যেসব প্রাক-বাজেট আলোচনা হতো, এনবিআরের সেসব সভায় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতির সুযোগ রাখা হতো। সহকর্মীরা বা অনেক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ইতস্তত করতেন সেসব সভায় মিডিয়ার উপস্থিতিতে। আমার যুক্তি ছিল, এ দেশের অর্থনীতি সবার। আমজনতার। আর মিডিয়ার ভূমিকা বেশি অর্থনীতিকে জনবান্ধব বা সরব জ্ঞাতকরণের। সুতরাং কোন সংগঠন কোন বিষয়ে কী ধরনের যুক্তিতে, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাদের দাবিদাওয়া পেশ করছে, তা মিডিয়া প্রতিনিধিরা সরাসরি জানতে পারলে জনমত তৈরিতে তারা আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবেন। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের দর্শন ছিল— দেশের অর্থনীতি বোঝার দায়িত্ব শুধু অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারক ও আমলাদের নয়, যাদের জন্য অর্থনীতি, যাদের জন্য ও নিয়ে অর্থনীতি, সেই আমজনতার, সবার। জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। আর তা গড়ে তোলায় সংবাদমাধ্যমের অবশ্যই করণীয় আছে। ঠিক এ দর্শনের ভিত্তিতে তার জীবনের সফলতম কাজ ছিল একটি সত্যিকারের ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতিবিষয়ক দৈনিকের সূচনা এবং ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে সমৃদ্ধ করা। তিনি একঝাঁক চৌকস রিপোর্টার, অর্থনীতি বিশ্লেষক, সহসম্পাদকের মেন্টরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রফেশনালিজম গড়ে তোলার ওপর তার তাগিদ ছিল সবসময়। দৌলত আক্তার মালাকে এনবিআর সম্পর্কে রিপোর্ট বিট করতে দেখেছি বহুদিন এবং তার বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন সক্ষমতা বৃদ্ধির তদারকিতে শুনেছি এই সেদিনও মোয়াজ্জেম ভাই ছিলেন তত্পর। মোফাজজল, পুঁজিবাজারের প্রদায়ক, সম্পাদকের কড়া দিকনির্দেশনায় তার অভিজ্ঞান ও পারঙ্গমতা বাড়তে দেখেছি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান থাকার সময়।
সরকারি-বেসরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর আমরা যারা একটু-আধটু লেখালেখি করি, তাদের তিনি সবসময় আহ্বান জানাতেন, উৎসাহিত করতেন তার পত্রিকায় লিখতে। উদ্দেশ্য, আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে যাতে পাঠকের চিন্তাভাবনার উপলব্ধির স্তর প্রসারিত ও শানিত হয়। লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সিন্ডিকেট ভাবনায় সারথি হয়ে একই রঙের কাগজে একই ফন্টে ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস বের হয়। পত্রিকাটি দিনকে দিন অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও সৃজনশীল প্রতিবেদনে সমৃদ্ধ হয়ে বের হচ্ছে। আমাকে সপ্তাহে একটি করে লেখা দেয়ার দাবি ছিল তার। হাসপাতালে তার সঙ্গে শেষ কথা টেলিফোনে। আমি ফোন করেছিলাম, তিনি ধরছেন না। তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না মনে করে রেখে দিলাম। ১ মিনিটের মধ্যে মোয়াজ্জেম ভাই কল ব্যাক করলেন। বললাম, ‘ভাই, আপনার সব খবর জানি। আপনি ভালো হয়ে উঠুন।’ বললেন, ‘কয়েক দিনের জন্য সিঙ্গাপুর ডাক্তার দেখাতে যাব। আপনি কিন্তু নিয়মিত লেখা দিতে ভুল করবেন না।’ এই শেষ কথা। আমিও দেশের বাইরে গেলাম। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন এ খবর রাখতাম। কিন্তু ১ আগস্ট ভোরে হযরত শাহজালালে নেমেই দৌলত আক্তার মালার মেসেজ— ‘মোয়াজ্জেম ভাই নেই।’ সকাল ১০টায় আমাদের আবাসস্থল রমনা এস্টেট কমপ্লেক্সের চত্বরে তার প্রথম জানাজায় অংশ নিলাম।
না, মোয়াজ্জেম ভাই লেখা দিতে ভুলব না। কিন্তু কার কাছে পাঠাব? লেখায় তাগিদ থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে প্রেরণা, পরামর্শ, বিষয় নির্বাচন ও বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের শূন্যতা বোধ করছি একান্ত অনুভবে।
লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান