বীমায় ৫০৯ ও ব্যাংকে ১১২ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০১৮-০৮-৩০ ২০:২৩:৪৬
২০১৭ বছরে বীমা খাতে সেবা গ্রহণের উপর ৫০৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভুত ভাবে অর্থের লেনদেন হয়েছে। একই ভাবে ব্যাংকিং খাতে ১১২ কোটি ৯০ লাখ টাকার লেনদেন হয়ছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৭ সালে করা খানা জরিপে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার জরিপটি প্রকাশ করে টিআইবি।
আজ বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস ভবনে টিআইবির কার্যালয়ে এ জরিপ তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল ও নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
বীমা: প্রতিবেদনে বীমা বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশে সরকারি ও বেসকারিভাবে ৭৭টি বীমা কোম্পানি কাজ করছে। আর এ খাত থেকে সাধারণ জনগণের সেবা নেওয়ার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই খাত থেকে সেবা গ্রহণের সময় জনগণকে নানা ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হতে হয়।
জরিপে অন্তর্ভুক্ত খানাগুলোর ১৮.২ শতাংশ বীমা সেবা গ্রহণ করেছে। বীমা সেবাগ্রহীতা খানার ৯.৩ শতাংশ সরকারি ও ৮৮ শতাংশ বেসরকারি। জীবন বীমা সেবা নিয়েছে ৬২.৯ শতাংশ খানা এবং সঞ্চয় বীমা সেবা নিয়েছে ৩০.৯ শতাংশ খানা।
বীমা খাতে সেবা নেওয়া খানার ১২.৩ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। বীমা সেবাগ্রহণকারী খানার ৬.৭ শতাংশ সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনে অনীহা, ৬.৫ শতাংশ প্রতারণার শিকার এবং ৪.৯ শতাংশ ঘুষ বা অর্থ আত্মসাৎ এবং ০.৫ শতাংশ খানা অসদাচরণ ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছে। সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার খানা গড়ে ১৪ হাজার ৮৬৫ টাকা ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের শিকার হয়েছে।
সরকারি বীমা সেবাগ্রহণকারী খানার ৯.৭ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি এবং ৪.৬ শতাংশ ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের শিকার হয়েছে যা বেসরকারি বীমার ক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ ও ৫.১ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি বীমা কোম্পানি থেকে সেবা নিতে গিয়ে খানাকে গড়ে যথাক্রমে ১০ হাজার ৫২ টাকা এবং ১৫ হাজার ৩৫০ টাকা ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের শিকার হতে হয়েছে।
জীবন বীমা সেবা গ্রহণকারী খানার ১২.৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এছাড়া ১৪.৪ শতাংশ সঞ্চয় বীমা সেবায়, ১.৩ শতাংশ মোটরযান বীমা সেবায় এবং ১.৩ শতাংশ অন্যান্য (স্বাস্থ্য বীমা, শিক্ষা বীমা, আগুন ও দুর্ঘটনা বীমা, ইত্যাদি) বীমায় দুর্নীতির শিকার হয়। জীবন বীমা সেবা গ্রহণকারী খানার ৫.৬ শতাংশ, সঞ্চয়বীমা ৪.৩ শতাংশ, মোটরযান ০.৫ শতাংশ এবং অন্যান্য বীমা সেবা গহণকারী খানার ০.৫ শতাংশ ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের শিকার হয়েছে। জীবন বীমায় ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের শিকার খানা গড়ে ২৬ হাজার ২২৭ টাকা এবং সঞ্চয় বীমায় গড়ে ১৬ হাজার ৪৩৭ টাকা ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের শিকার হয়েছে।
ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বীমা সংক্রান্ত সেবা গ্রহণকারী খানাগুলো যারা ঘুষ দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে তারা কারণ হিসেবে হয়রানি বা জটিলতা এড়ানো (৮৪.১ শতাংশ), টাকা না দিলে সেবা না পাওয়া (৫৪.৮ শতাংশ), নির্ধারিত ফি জানা না থাকায় অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া (১৭.১ শতাংশ), নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া (১২.৪ শতাংশ) এবং নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়া (৫ শতাংশ) উল্লেখ করেছে।
ব্যাংকিং: জরিপে অন্তর্ভুক্ত খানার ৬৭.১ শতাংশ ব্যাংক থেকে সেবা গ্রহণ করছে। সেবাগ্রহণকারী খানার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৫৪.৩ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৫০.৬ শতাংশ, কৃষি ব্যংক/রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৭.৬ শতাংশ, অন্যান্য বিশেষায়িত ব্যাংক ১ শতাংশ, বৈদেশিক বাণিজ্যিক ব্যাংক ০.৫ শতাংশ এবং অ-তফসিলি ব্যাংক থেকে ৫.৫ শতাংশ সেবা গ্রহণ করেছে। এছাড়া খানার সদস্যরা ব্যাংক থেকে যেসব সেবা নিয়েছে তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ খানা টাকা উত্তোলন, ৪৭.৪ শতাংশ খানা বিভিন্ন পরিসেবার বিল প্রদান, ৪৩.৭ শতাংশ খানা টাকা জমা, ১৫.৫ শতাংশ খানা ডিপিএস, ১০ শতাংশ খানা বেতন, ভাতা ও পেনশন উত্তোলন, ৯ শতাংশ খানা ঋণ গ্রহণ (ব্যক্তিগত, বাড়ি নির্মাণ, গাড়ি ক্রয়) করেছে।
সেবা গ্রহণকারী খানার মধ্যে ৫.৭ শতাংশ খানা বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেবা গ্রহণকারী খানার মধ্যে ১.১ শতাংশ খানাকে ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভুত অর্থ, ৩.৪ শতাংশ খানা সময় ক্ষেপন এবং ২.৯ শতাংশ খানা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অনীহা বা অসহযোগীতার সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া ১ শতাংশ অন্যান্য (প্রতারণা, মৌখিকভাবে আংশিক তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপন করা, ভাংতি টাকা না দেওয়া, ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ না করলে ডিপিএসের টাকা জমা না নেওয়া প্রভৃতি) বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ব্যাংক থেকে সেবা নিতে যেসব খানা ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভুত অর্থ দিয়েছে তাদের গড়ে ৩ হাজার ৯৮৫ টাকা (গ্রামাঞ্চলে ২ হাজার ৭৪৬ টাকা এবং শহরাঞ্চলে ৪ হাজার ৮৫৭ টাকা) দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানভেদে সেবা গ্রহণকালে ৭.৪ শতাংশ খানা কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ৭.২ শতাংশ খানা অন্যান্য অ-তফসিলি ব্যাংক, ৫.৪ শতাংশ খানা রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪.৪ শতাংশ খানা বিশেষায়িত ব্যাংক এবং ৩.৫ শতাংশ খানা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
সেবার ধরন অুনযায়ী দেখা যায়, ১২.৩ শতাংশ খানা ঋণ গহণ সংক্রান্ত সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এছাড়া ৯.৪ শতাংশ কৃষি ঋণ গ্রহণে, ৮.২ শতাংশ খানা মেয়াদি সঞ্চয় হিসাবের ক্ষেত্রে, ৪.৬ শতাংশ খানা রেমিট্যান্স উত্তোলন, ৪.৫ শতাংশ খানা সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচীর আওতায় প্রাপ্ত ভাতা উত্তোলন, ৪ শতাংশ খানা ডিপিএস সংক্রান্ত, ৩.৩ শতাংশ খানা চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবরক্ষণ সংক্রান্ত, ৩.১ শতাংশ খানা বেতন, ভাতা ও পেনশন উত্তোলন, ২.৬ শতাংশ খানা বিভিন্ন পরিসেবার বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
জরিপে ঘুষের শিকার হওয়া খানা ঘুষ দেওয়ার যেসব কারণ উল্লেখ করেছে তার মধ্যে ঘুষ বা অতিরিক্ত অর্থ না দিলে সেবা না পাওয়া (৬১.৬ শতাংশ), হয়রানি বা ঝামেলা এড়ানো (৫১.৪ শতাংশ), নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়া (৩৯.৮ শতাংশ), দ্রুত সেবা পাওয়া (১৩ শতাংশ) অন্যতম। এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত ফি জানা না থাকায় অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া (৪.৩ শতাংশ), অবৈধভাবে ঋণ পাওয়া (১.৩ শতাংশ)।