বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত যশোরের যৌনপল্লীর যৌনকর্মীদের পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ খোলার উপায় ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি টিএসআই রফিক যশোর থেকে বদলি হয়ে যাওয়ায় কথা বলার সুযোগ পেলেন তারা। সোমবার দুপুরে যশোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে অমানুষিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন যৌনকর্মীরা।
তাদের অভিযোগ, প্রতিদিন তারা শরীর বিক্রি করে টাকা উপার্জন করেন। আর তাদের দেহ বিক্রির টাকায় ভাগ বসায় পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা। সদর ফাঁড়ির প্রাক্তন টিএসআই রফিক এদের অন্যতম। মাসে তার চাহিদা ছিল লাখ লাখ টাকা। নানা কায়দায় অত্যাচার নির্যাতন করে এই টাকা আদায় করা হতো। আর একটু এদিক ওদিক হলেই যৌনকর্মীদের ওপর শুরু করতেন অমানুষিক নির্যাতন। প্রতিনিয়ত পুলিশের ওই কর্মকর্তার নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেকে। কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে যৌনকর্মী সোনিয়া বলেন, আমাদের কাছে নতুন কোনো মেয়ে এলে, তাকে প্রথমে ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা রাখার অনুমতি দিলেই আমরা রাখি। এজন্য তারা ৫০/৬০ হাজার টাকা নেয়। তাই যৌনকর্মী তৈরি করে পুলিশ, আমরা না। আর এ নিয়ে কিছু হলে আমরা আসামি হই। তা কেন হবে? এ প্রশ্ন যৌনকর্মীদের।
লিখিত বক্তব্যে সোনিয়া আরও অভিযোগ করেন, যশোরের যৌনপল্লীর নাইটগার্ড আবুল কাশেম ও তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম তার নিজ ঘরে টিয়া নামের একটি মেয়েকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করতো। ওই মেয়েটির পরিবার তার সন্ধান পেয়ে র্যাবের কাছে অভিযোগ দেয়। এরপর র্যাবের অভিযানে মেয়েটি উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় কাসেম, রাবেয়া, আঞ্জু, ডলি ও হিরার নামে মামলা হয়। এর বাইরে কাউকে আসামি করা হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ গত ২৯ অক্টোবর সদর ফাঁড়ির প্রাক্তন টিএসআই রফিক যশোরে এসে যৌনকর্মী সোনিয়া ও স্বপ্নাকে ডেকে পাঠায়। তাদের কাছে রফিক ৩ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করে। না দিলে তাদের ওই মামলায় ঝুলিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এমনকি বাগেরহাটের মংলা থানায় ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দিয়ে সোনিয়া ও স্বপ্নাকে চার্জশিটভুক্ত করারও ভয় দেখান রফিক। টিএসআই রফিক দম্ভোক্তি করে বলেন, ‘তোদের কোনো বাপ থাকলে ঠেকাতে বলিস। আর মনে রাখিস তিন লাখ টাকা না দিলে ওই কেসে বাঁচতে পারবি না।’
শুধু এই ঘটনা নয়, যশোর সদর ফাঁড়ির সাবেক এই টিএসআইয়ের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে বলে লিখিত বক্তব্যে জানান সোনিয়া। তিনি আরও উল্লেখ করেন, সদর ফাঁড়ির টিএসআই দায়িত্বে থাকাকালীন যৌনপল্লীতে কোনো নতুন মেয়ে এলে রফিককে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হতো। কিন্তু আগে ৫-১০ হাজার টাকায় রফা হতো। যৌনকর্মীদের কাছ থেকে সে নিয়মিত প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা করে উৎকোচ আদায় করেছে। রফিকের উৎকোচের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে আমরা খরিদ্দারের কাছ থেকে অতিরিক্ত ২০টাকা আদায় করেছি। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে আমাদের ওপর শুরু হতো নির্যাতন। টিএসআই রফিক যৌনপল্লীতে ঢুকে কোনো খদ্দের দেখলে মাদক দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা আদায় করেছে; এমন ঘটনাও আছে। এভাবে যৌনপল্লী থেকে প্রতিমাসে ১-২ লাখ টাকা উপার্জন হতো তার। এছাড়াও যৌনপল্লীতে কোনো লোক ঢুকলেই সোর্সের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে হাজির হতো টিএসআই রফিক। এরপর ব্লাকমেইলিং করে ৫০-৬০ হাজার টাকা পর্যন্তও আদায় করতো। এতদিন তার ভয়ে কোনো যৌন কর্মী মুখ খুলতে সাহস পায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত টিএসআই রফিকের নির্যাতনের শিকার ১০-১২জন যৌন কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তারা রফিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে যশোর পুলিশের মুখপাত্র শাফিন মাহমুদ জানান, টিএসআই রফিকের বিরুদ্ধে এর আগে কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিছুদিন আগে তাকে কুষ্টিয়ায় বদলি করা হয়েছে।
সানবিডি/ঢাকা/রাআ