একজন মুমিনের অন্যতম কাজ হলো, সে নিয়মিত নামাজ আদায় করবে। আর নামজের কিছু নিয়ম কানুন আছে। আজকে আমরা জানবো নামাজের ফরজ ও ওয়াজিবগুলো। আগামী কাল জানবো সুন্নাত,মুস্তাহাব,মাকরূহ ও নামাজ ভঙ্গের কারনসমুহ
নামাজের ফরজ
আহকাম ও আরকান মিলিয়ে নামাজের ফরজ মোট ১৩টি। নামাজ শুরু হওয়ার আগে বাইরে যেসব কাজ ফরজ, সেগুলোকে নামাজের আহকাম বলা হয়।নামাজের আহকাম ৭টি। যথাঃ
১. শরীর পাক হওয়াঃ এ জন্য অজুর দরকার হলে অজু বা তায়াম্মুম করতে হবে, গোসলের প্রয়োজন হলে গোসল বা তায়াম্মুম করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে আল্লাহ বলেনঃ
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ فَٱغْسِلُوا۟ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى ٱلْمَرَافِقِ وَٱمْسَحُوا۟ بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى ٱلْكَعْبَيْنِ ۚ
হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)। (সূরা মায়েদাঃ ৬)
২. কাপড় পাক হওয়াঃ পরনের জামা, পায়জামা, লুঙ্গি, টুপি, শাড়ি ইত্যাদি পাক পবিত্র হওয়া।এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র কর। (সূরা মুদ্দাসসিরঃ ৪)
৩. নামাজের জায়গা পাক হওয়াঃ অর্থাৎ নামাজির দু’পা, দু’হাঁটু,দু’হাত ও সিজদার স্থান পাক হওয়া।
৪. সতর বা শরীর ঢাকাঃ পুরুষের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং মহিলাদের দু’হাতের কব্জি,পদদ্বয় এবং মুখমন্ডল ব্যতীত সমস্ত দেহ ঢেকে রাখা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ
يَٰبَنِىٓ ءَادَمَ خُذُوا۟ زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ
অর্থঃ হে বনী আদম, তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের বেশ-ভূষা গ্রহণ কর। (সূরা আরাফঃ৩১)
৫. কিবলামুখী হওয়াঃ কিবলা মানে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়া।এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ
وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا۟ وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ
আর তুমি যেখান থেকেই বের হও, তোমার চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকে তোমাদের চেহারা ফিরাও। (সূরা বাকারাঃ ১৫০)
৬. ওয়াক্ত অনুযায়ী নামাজ পড়াঃ প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজ সময়মতো আদায় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃإِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ كَانَتْ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ كِتَٰبًا مَّوْقُوتًا নিশ্চয় সলাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয। (সূরা নিসাঃ১০৩)
৭. নামাজের নিয়্যাত করাঃ নামাজ আদায়ের জন্য সেই ওয়াক্তের নামাজের নিয়্যাত করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ إنما الأعمال بالنية নিশ্চই আমলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল। (বুখারী,হাদিস-১)
নামাজ শুরু করার পর নামাজের ভেতরে যেসব কাজ ফরজ, সেগুলোকে নামাজের আরকান বলা হয়। নামাজের আরকান ৬টি।যথাঃ
১. তাকবিরে-তাহরিমা বলাঃ অর্থাৎ আল্লাহর বড়ত্বসূচক শব্দ দিয়ে নামাজ আরম্ভ করা। তবে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে নামাজ আরম্ভ করা সুন্নাত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। (সূরা মুদ্দাসসিরঃ৩)
২. দাঁড়িয়ে নামাজ পড়াঃ মানে কিয়াম করা। আল্লাহ বলেনঃ حَٰفِظُوا۟ عَلَى ٱلصَّلَوَٰتِ وَٱلصَّلَوٰةِ ٱلْوُسْطَىٰ وَقُومُوا۟ لِلَّهِ قَٰنِتِينَ
তোমরা সলাতসমূহ ও মধ্যবর্তী সালাতের হিফাযত কর এবং আল্লাহর জন্য দাঁড়াও বিনীত হয়ে। (সূরা বাকারাঃ ২৩৮)
৩. ক্বেরাত পড়াঃ চার রাকাতনিশিষ্ট ফরজ নামাজের প্রথম দু’রাকাত এবং ওয়াজিব,সুন্নাত,নফল নামাজের সকল রাকাতে ক্বিরাত পড়া ফরজ। আল্লাহ বলেনঃ فَٱقْرَءُوا۟ مَا تَيَسَّرَ مِنَ ٱلْقُرْءَانِ
অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়। (সূরা মুযাম্মিল,আয়াতঃ ২০)
৪. রুকু করাঃ প্রতিটি নামাজের প্রত্যেক রাকাতে রুকু করা ফরজ।এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
وَأَقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُوا۟ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرْكَعُوا۟ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ
অর্থঃআর তোমরা সলাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর। (সূরা বাকারাঃ৪৩)
৫. সিজদা করাঃ নামাজের প্রত্যেক রাকাতে সিজদা করা ফরজ।আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱرْكَعُوا۟ وَٱسْجُدُوا۟ وَٱعْبُدُوا۟ رَبَّكُمْ وَٱفْعَلُوا۟ ٱلْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ۩
অর্থঃ হে মুমিনগণ, তোমরা রুকূ’ কর, সিজদা কর, তোমাদের রবের ইবাদাত কর এবং ভাল কাজ কর, আশা করা যায় তোমরা সফল হতে পারবে। (সূরা হজ্জঃ৭৭)
৬. শেষ বৈঠক করাঃ নামাজের শেষ রাকাতে সিজদার পর তাশহুদ পড়তে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় বসা।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ثُمَّ اجْلِسْ فَاطْمَئِنَّ جَالِسًا ثُمَّ قُمْ فَإِذَا فَعَلْتَ ذَلِكَ فَقَدْ تَمَّتْ صَلاَتُكَ
অর্থ, “অতঃপর ধীর স্থিরভাবে উঠে বসবে। পরে উঠে দাঁড়াবে। এইরূপ করতে পারলে তবে তোমার সালাত পূর্ণ হবে।স
সূত্রঃ বুক অব ইসলামিক নলেজ, লেখকঃ ইকবাল কবীর মোহন
নামাযের ওয়াজিবসমূহ
ওয়াজিব অর্থ হলো আবাশ্যক। নামাযের মধ্যে কিছু বিষয় আছে অবশ্য করণীয়। তবে তা ফরজ নয়, আবার সুন্নাতও নয়। যা ভুলক্রমে ছুটে গেলে সিজদায়ে সাহু দিতে হয়।আর ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিলে নামায ভঙ্গ হয়ে যায়। নিচে ওয়াজিবসমূহ উপস্থাপন করা হলো । রুকন এর পরেই ওয়াজিব এর স্থান, যা আবাশ্যিক। যা ইচ্ছাকৃতভাবে তরক(বাদ) করলে নামায বাতিল হয়ে যায় এবং ভূলক্রমে তরক করলে ‘সিজদায়ে সাহু’ দিতে হয়। নামাযের ওয়াজিব মোট ১৪টি।যথাঃ
১. সূরা ফাতিহা পাঠ করাঃ ফরয নামাযের প্রথম দু’ রাক‘আতে এবং সকল প্রকার নামাযের প্রত্যেক রাকা‘আতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল সব ধরণের নামাযের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। এটাই ইমাম আবু হানিফা (রহতুল্লাহ আলাই) এর অভিমত। তবে ইমাম শাফেয়ী (রহমতুল্লাহ আলাই)এটাকে ফরয হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তাঁর দলিল-
لاً صَلاَة لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَا تِحَةِ الْكِتاَبِ
“যে নামাযে ফাতিহা পাঠ করেনি তার নামায হয়নি” (বুখারী)
২. সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা মিলানোঃ ফরয নামাযসমূহের প্রথম দু’রাক’আতে সূরা ফাতিহার সাথে যেকোনো সূরা বা আয়াত মিলিয়ে পড়া কমপক্ষে বড় এক আয়াত বা ছোট তিন আয়াত পাঠ করা আবশ্যক।
৩. তারতীব মত নামায আদায় করাঃ তারতীব অনুযায়ী নামায অর্থাৎ নামাযে যে সকল কাজ বারবার আসে ঐ কাজগুলোর ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা ওয়াজিব। যেমন রুকু, ও সিজদা যা নামাযের প্রতি রাক’আতে বারবার আসে। কিরা’আত পাঠ শেষ করে রুকু’ এবং রুকু শেষ করে উঠে সিজদা করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে নামায নষ্ট হবে এবং নতুন করে নামায আদায় করতে হবে।
৪. প্রথম বৈঠকঃ চার রাকা’আত ও তিন রাকা’আত বিশিষ্ট নামাযে দু রাকা’আত শেষ করে আত্তাহিয়্যাতু পাঠ করতে যতটুকু সময় লাগে, সে পরিমাণ সময় পর্যন্ত বসে থাকা ওয়াজিব।
৫. আত্তাহিয়্যাতু পাঠ করাঃ নামাযের উভয় বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পাঠ করা ওয়াজিব। আমরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন, তুমি আত্তাহিয়্যাতু পড়। সুতরাং আলোচ্য হাদীসটিই প্রথম ও শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পাঠ করা ওয়াজিব সাব্যস্ত করে।
৬. প্রকাশ্য কিরা’আত পাঠ করাঃ যে সকল নামাযে প্রকাশ্য বা উচ্চঃস্বরে কিরা’আত পাঠ করার নির্দেশ রয়েছে সেগুলোতে প্রকাশ্য কিরা’আত পাঠ করা ওয়াজিব। যেমন-ফজর, মাগরিব, ইশা, জুমু‘আ’ দু’ঈদের নামায ও তারাবীর নামায। অবশ্য একাকী আদায় করলে কিরা’আত উচ্চঃস্বরে পাঠ করা আবশ্যক নয়।
৭. চুপিসারে কিরা‘আত পাঠ করাঃ যেমন নামাযে চুপে চুপে কিরা’আত পাঠ করার নির্দেশ রয়েছে সেসব নামাযে নীরবে বা চুপে চুপে কিরা’আত পাঠ করা ওয়াজিব। যেমন- যোহর ও আসরের নামায।
৮. তা’দীলে আরকান বা ধীরস্থিরভাবে নামায আদায় করাঃ নামাযের সব কাজ ধীরে-সুস্থে করতে হবে। যেমন রুকু’ ও সিজদা নিশ্চিত ও প্রশান্ত মনে তাড়াহুড়া না করে ভালোভাবে আস্তে আস্তে আদায় করা ওয়াজিব।
৯. রুকু’থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোঃ অর্থাৎ রুকু’ শেষে সিজদা করার পূর্বে সোজা হয়ে দাঁড়ানো।
১০. সিজদা থেকে সোজা হয়ে বসাঃ দু’ সিজদার মাঝখানে সোজা হয়ে বসা ওয়াজিব।
১১. সালাম বলাঃ নামায শেষে “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ” বলে নামায শেষ করা। ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহ আলাই এর মতে এটি ফরজ।
১২. তারতীব ঠিক রাখাঃ প্রত্যেক রাকা’আতের তারতীব বা ধারাবাহীকতা ঠিক রাখা অর্থাৎ আগের কাজ পেছনে এবং পেছনের কাজ আগে না করা।
১৩. দু’আ কুনুত পাঠ করাঃ বেতরের নামাযে দু’আ কুনুত পাঠ করা ওয়াজিব।
১৪. ঈদের নামাযে তাকবীরঃ দুই ঈদের নামযে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবীর বলা ওয়াজিব।
সূত্রঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামায, দারুস সালাম বাংলাদেশ
ইসলামের বিধিবিধান জানতে নিয়মিত চোখ রাখুন সানবিডি ২৪ ডটকমে....। আগামীকাল আলোচনা হবে..সুন্নাত,মুস্তাহাব,মাকরূহ ও নামাজ ভঙ্গের কারনসমুহ নিয়ে.....