তাহলে কি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টেস্ট ব্যাটিং ভুলে যাচ্ছেন? বেশি বেশি ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি খেলতে গিয়ে পাঁচ দিনের খেলার মেজাজ, মনোসংযোগ, ধৈর্য্য কি কমে যাচ্ছে তাদের? টেস্ট ব্যাটিংয়ের যে অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন ও টেকনিক- তাতেও কি ঘাটতি দেখা দিয়েছে?
যদি তাই না দেবে, তাহলে সিলেটে প্রথম টেস্টে ব্যাটিংয়ের এমন হতচ্ছিরি অবস্থা কেন? যে মাসাকাদজার দল তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে পাত্তাই পায়নি, চরমভাবে পর্যদুস্ত হয়েছে- সেই জিম্বাবুয়ের কাছে কেন ১৪৩ রানে অলআউট হওয়া? তবে কি সত্যিই টেস্ট ব্যাটিংটা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে টাইগারদের?
যদিও দেশের বাইরে, তারপরও শেষ তিন টেস্টের ব্যাটিং পরিসংখ্যানকে মানদন্ড ধরলে কিন্তু তাই মনে হবে। টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের কি অবস্থা তা আজকের ইনিংসটিসহ সর্বশেষ সাত ইনিংস দেখলেই বোঝা সম্ভব। সর্বশেষ সাত ইনিংসে বাংলাদেশ একবারের জন্য বড়সড় স্কোর গড়তে পারেনি। বড়সড় তো বহদুরে, ২০০ রানও করতে পারেনি। সর্বশেষ ছয় ইনিংসে টাইগারদের স্কোর ছিল যথাক্রমে- ১১০, ১২৩, ৪৩, ১৪৪, ১৪৯, ১৬৮। গড় রান ১২৩ করে।
সর্বশেষ আজ হলো মাত্র ১৪৩। স্কোর লাইন পরিষ্কার জানাচ্ছে, ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্যই গেছে কমে। নতুবা টেস্ট ব্যাটিং ভুলে গেছেন ব্যাটসম্যানরা। তাই কোনো কোনো বিশ্লেষক বলেন যে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টেস্ট ব্যাটিং ভুলে গেছেন। তাহলে সেটা কি খুব ভুল হবে? কিংবা কোন বাড়াবাড়ি বলা যাবে?
বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটিংয়ের মান যে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, পারফরমেন্সের গ্রাফ যে নিচের দিকে নামছে, তার পক্ষে আরও দুটি দলিল আছে। প্রথম দলিল হচ্ছে, এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চার বছর আগে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে টাইগাররা জিতেছিল হেসে খেলেই। জিম্বাবুইয়ানদের সব ম্যাচ হারিয়ে রীতিমত বাংলাওয়াশ করে ছেড়েছিল মুশফিকের দল।
আসুন একনজরে ওই সিরিজের তিন টেস্টের চালচিত্র দেখে নেই- সময়কাল ছিল ২০১৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর। মানে ঠিক এই সময়টায়। সেবার ওয়ানডের পাশাপাশি টেস্টেও বাংলাদেশের কাছে তুলোধুনো, হোয়ইটওয়াশ, ধবলধোলাই কিংবা বাংলাওয়াশ যাই বলা হোক না কেন- সবই হয়েছিল জিম্বাবুয়ে।
তিন ম্যাচের সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জিতেছিল মুশফিকুর রহীমের দল। ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্টে ৩ উইকেটে জিতেছিল টাইগাররা। খুলনায় দ্বিতীয় টেস্টে মুশফিক বাহিনীর কাছে ১৬২ রানের বড় ব্যবধানে হার মেনেছিল জিম্বাবুইয়ানরা। আর চট্টগ্রামে তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ১৮৬ রানের বিশাল ব্যবধানে।
ওই সিরিজে টাইগারদের সর্বনিম্ন স্কোর ছিল ১০১। ঢাকায় প্রথম টেস্টে জয়ের লক্ষ্যে ১০১ রানের পিছু ধাওয়া করে ৭ উইকেট খুইয়ে লক্ষ্যে পৌঁছেছিল মুশফিক বাহিনী। প্রথম ইনিংসের স্কোর ছিল ২৫৪। খুলনা ও চট্টগ্রামে পরের দুই টেস্টে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪৩৩ ও ২৪৮/৯ ডি.। আর ৫০৩ ও ৩১৯/৫ ডি.।
অন্যদিকে জিম্বাবুয়ের স্কোর ছিল যথাক্রমে ঢাকায়; ২৪০ ও ১১৪। খুলনায় ৩৬৮ ও ১৫১ টার্গেট ছিল ৩১৪ এবং চট্টগ্রামে ৩৭৪ ও ২৬২ (টার্গেট ৪৪৯)। চার বছর পর এবার সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৪৩ রানের মামুলি স্কোর- ভাবা যায়!
পরিসংখ্যান জানিয়ে দিচ্ছে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দেশে ও জিম্বাবুয়ের মাটিতে এটা বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বনিম্ন স্কোর। এরচেয়ে কম রানে অলআউট হবার রেকর্ড আছে মোটে দুবার; সর্বনিম্ন স্কোর ১০৭। ২০০১ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ট্রেভিস ফ্রেন্ড আর হিথ স্ট্রিকের বোলিং তান্ডবে অত কম রানে অলআউট হয়েছিল বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশ তখন টেস্টে সদস্যজাত শিশু।
তারপর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোরটি (১৩৪) ১৭ এপ্রিল ২০১৩ হারারে মাঠে। ওই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪৭ রানে অলআউট হবার রেকর্ড আছে বাংলাদেশের। আর এবার তারচেয়েও ৪ রান কম ১৪৩।
ওপরের পরিসংখ্যান পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, টেস্ট ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের দৈন্যদশা। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ব্যাটিং খারাপ হবার পর ভক্তরা মনকে প্রবোধ দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, ক্যারিবীয় বোলিং লাইনআপে কেমার রোচ, শ্যানন গ্যাব্রিয়েল আর জেসন হোল্ডাররা ছিলেন। তাদের ১৪০ প্লাস গতি ও বিষাক্ত সুইং সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু ঘরের মাঠে সিলেটের মরা ও প্রাণহীন পিচে চাতারা, জারভিসদের সাদামাটা পেস বোলিং আর অফস্পিনার সিকান্দার রাজার বল খেলতে গিয়ে নাভিঃশ্বাস ওঠার কারণ কি? উইকেটে কিচ্ছু নেই। বল সুইংও করেনি তেমন। খুব একটা টার্নও নেই। তবে কেন এমন করুণ দশা?
আসল কথা হচ্ছে, টেস্ট ব্যাটিং মানেই পরিশুদ্ধ ও ব্যাকরণসন্মত ব্যাটিং। ধৈর্য্য, সংযম, মনোযোগ-মনসংযোগ আর পরিশুদ্ধ টেকনিকের অনুপম মিশেল। এখানে সীমিত ওভারের মত ইম্প্রোভাইজ করে খেলা, বলের পিছনে শরীর ও পা না এনে গায়ের জোরে, কিংবা ভালো রিফ্লেক্সের ওপর খেলে সফল হওয়া সম্ভব নয়। আর ঠিক ওই জায়গায় এখনো পরিষ্কার পিছিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। বেশির ভাগেরই টেকনিক ও অ্যাপ্লিকেশনে ফাঁক-ফোকর আছে।
দূর্বল ফুটওয়ার্কই বড় কারণ। বলের পিছনে শরীর ও পা না নিয়ে দুর থেকে ব্যাট চালানোর প্রবণতাই বেশি। ক্রমাগত একদিনের সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলার কারনে সোজা ব্যাটে খেলার মানসিকতাও গেছে কমে। তার বদলে ইম্প্রোভাইজ করে খেলার মানসিকতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। আর তাই টেস্টের পরিশুদ্ধ গাণিতিক বা ব্যাকরণ সন্মত ব্যাটিং হচ্ছে না।
আজ (রোববার) সকালে ইমরুল কায়েস আর লিটন দাস ওভাবে পা না বাড়িয়ে, বলের পিছনে শরীর ও পা না নিয়ে ব্যাট চালাতে গিয়ে ইমরুল হলেন ‘প্লেইড অন।’ পা বাড়িয়ে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করলে বল মাঝ ব্যাটে আসতো; কিন্তু ইমরুল যা খেললেন, তাকে ক্রিকেটীয় পরিভাষায় বলে ‘হাফ কক’। অর্ধেক আসলেন, আর বাকিটা না এসে ব্যাট পেতে দিলেন। বল ব্যাটের ভিতরের কানায় লেগে স্ট্যাম্পে গিয়ে আঘাত হানলো। আর লিটন দাস সামনের পায়ে ড্রাইভ করার বলকে জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে হলেন কট বিহাইন্ড।
টেস্ট স্পেশালিস্ট মুমিনুল অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল তাড়া করে স্লিপে দিলেন ক্যাচ। তাও কাইল জারভিস বা চাতারার পেস বোলিংয়ে নয়। সিকান্দার রাজার অফ ব্রেকের পিছু ধেয়ে। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ খালি হাতে ফিরেছেন চাতারার শার্প ইনকাটারে। শতভাগ গুডলেন্থ স্পটে না পড়ে দ্রুত ভিতরে ঢোকা ডেলিভারির বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ সামনের পায়ে ডিফেন্স করতে গিয়ে ব্যর্থ। ব্যাটের ভিতরে লেগে বল গিয়ে লাগলো উইকেটে।
শুধু পা বাড়িয়ে না খেলার কারণেই যে ব্যাটিংয়ে ধ্বস, তাও নয়। অন্য কারণও আছে। সেটাও ঘুরেঘিরে সেই সীমিত ওভারের ফরম্যাট বেশি খেলার মানসিকতা জেঁকে বসার কারণে। জিম্বাবুয়ের এক নম্বর স্ট্রাইক বোলার কাইল জারভিসকে আগের বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ঠিক পরের বলে কট বিহাইন্ড সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীম। থ্রি কোয়ার্টার লেন্থ থেকে খানিক ওপরে ওঠা বল মুশফিকের ব্যাট ছুঁয়ে কিপার চাকাভার গ্লাভসে।
শেষ কথা একটাই- প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে হবে বেশি করে। দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ না খেলে কিংবা কম খেলে টেস্টে সফল হওয়া অসম্ভব। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বাহারি মার, দৃষ্টি নন্দন স্ট্রেক প্লে আর চার-ছক্কায় মাঠ গরম করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর প্রভাব বিস্তার আর পাঁচ দিনের ম্যাচে লম্বা ইনিংস সাজানো এক কথা নয়।
সেই বোধ-উপলব্ধি আর টেকনিক ও টেম্পরামেন্ট গড়ে তোলা খুব জরুরি। না হয় আগামীতে আরও খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ টেস্ট দলের সামনে!