কোনো কাজ বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বা বাস্তবায়ন করার জন্য যিনি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন তাকে উদ্যোক্তা বলা হয়। অর্থাৎ উদ্যোক্তা হল সংগঠক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদেশের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। এটি একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য এবং তার দূরদর্শিতার পরিচায়কও বটে। কিন্তু এ দেশের বাস্তবতায় এটি কতটা প্রয়োগযোগ্য?
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘Ease of Doing Business’ সূচকে চলতি বছরের র্যাংকিংয়ে আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশ এক ধাপ এগোলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম, যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও বাংলাদেশ থেকে ৯ ধাপ এগিয়ে রয়েছে।
দেশে শ্রম অনেক সস্তা হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আসেনি বাধাগুলো দূর না হওয়ায়। নীতি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। তাই বাংলাদেশ এখনও উদ্যোক্তাদের জন্য অত্যন্ত বন্ধুর। উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানারকম প্রশাসনিক জটিলতা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্যোক্তাবান্ধব নয়। দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ৯০ শতাংশ উদ্যোগই কৃষিভিত্তিক। অর্থাৎ জমির মালিক না হলে ব্যবসা শুরু করা মুশকিল। আর অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ পারিবারিক সূত্রে নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত। তাদের পড়াশোনাই চলে একমাত্র সম্বল সামান্য জমির ওপর নির্ভর করে বা জমি বিক্রির টাকায়।
সবচেয়ে বড় কথা, উদ্যোক্তা হওয়া বা বানানো কোনো রাতারাতি স্বপ্নলব্ধ প্রক্রিয়া নয়। এজন্য তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের জাতীয় বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যোক্তা তৈরির স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো কোর্স নেই। হয় না কোনো গবেষণা বা সেমিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খবরের শিরোনাম হন থিসিস কপি করে, গবেষণা বা আবিষ্কার করে নয়।
এমন শিক্ষাব্যবস্থার গর্ভ থেকে রাতারাতি লাখো উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসবে এ কল্পনা অবাস্তব। তাছাড়া অধিকাংশ ব্যাংক ঋণ দেয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে, হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকা, জামানত হিসেবে জায়গার দলিল প্রদান করা, নয়তো গ্যারান্টার থাকা। কিন্তু তরুণদের একটা বড় অংশ নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের, যাদের ব্যবসা শুরু করার পুঁজি বা সম্পত্তি কোনোটাই নেই।
নারীদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়া আরও দুরূহ, থাকে নানারকম পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ কণ্টকাকীর্ণ, অনুকূলে নয়। প্রতিষ্ঠিত বা পরীক্ষিত পথে ব্যবসা করলেই উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। একজন উদ্যোক্তা তার রাস্তা নিজে তৈরি করেন।
এখানে ঝুঁকির সম্ভাবনা শতভাগ। তাই যারা এ পথে হাঁটার সাহস করেন তাদেরকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতে হবে। নিতে হবে কার্যকর সব উদ্যোগ। কিন্তু বিষয়টা রীতিমতো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
অভিজ্ঞতা বলে, স্বল্প পুঁজি নিয়ে দরিদ্র পরিবারের যে শিক্ষিত তরুণরা ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের মধ্যে শতকরা পাঁচজনই সফল হয় না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব, পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক অবস্থা ও ঝুঁকি। যেমন, কেউ একজন মাছের চাষ বা গরুর খামার করল, কোনো কারণে মাছ বা ওই গরুগুলো মরে গেলে হতাশাগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্তদের পাশে কি কেউ দাঁড়ায়? সভা, সমাবেশ ও সেমিনারে আমরা বলতে পারি- উদ্যোক্তা হও, দেশ গড়ো। কিন্তু এর প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক ক’জন?
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উপরোক্ত বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান করে এর জন্য একটা অনুকূল ও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে যুগোপযোগী নীতিমালা। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় দেশের বর্তমান অপার সম্ভাবনাময় ও শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে চাকরি ক্ষেত্রে কাজে লাগানোই উচিত। এতে করে অন্তত বর্তমান প্রজন্ম কর্মে প্রবেশের মাধ্যমে দেশকে বেকারত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে পারবে। আর এই জনশক্তির অপচয় রোধকল্পে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগটা দ্রুত উন্মুক্ত করে দেয়াই যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করছি।
নাজমুল হোসেন : প্রকৌশলী, প্রাবন্ধিক
naymulhussen@yahoo.com