আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিএনপিকে। একদিকে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল, অন্যদিকে আসন বণ্টন নিয়ে শরিকদের চাপ। সব মিলিয়ে কপালে ভাঁজ পড়ছে দলটির শীর্ষ নেতাদের।
বিএনপির নির্বাচনী সঙ্গী দুই জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোট (সম্প্রসারিত ২৩ দল)। এ দুটি জোটে রয়েছে ২৭টি রাজনৈতিক দল। দুই জোটের মধ্যে ২০ দলের প্রধান শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে বিএনপির এক ধরনের সমঝোতা হয়ে গেছে।
জামায়াত ও এলডিপিকে বিএনপির সর্বাধিক আসনে ছাড় দিচ্ছে। বাকিদের সঙ্গেও সমঝোতা হওয়ার পথে। এখন বাকি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির ফয়সালা। ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোকে আসন দেয়া নিয়ে বিএনপি এক ধরনের চাপ অনুভব করছে।
তবে এ ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু জটিলতাও। ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলো যেসব আসন দাবি করছে, সেই আসনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন। আবার ২০ দলকে যেসব আসনে ছাড় দিতে চাইছে, সেগুলোর কোনো কোনোটাও ঐক্যফ্রন্টের চাহিদার মধ্যে রয়েছে।
সব মিলিয়ে ঐক্যফ্রন্টভুক্ত চারটি দলকে বিএনপি কয়টি আসন দিয়ে সন্তষ্ট করতে পারে, সেটিই এখন নেতাদের মূল ভাবনায়। আসন বণ্টন নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় বিএনপি জোটের দলগুলো নিজ নিজ দলের পক্ষে আবার কেউ ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
এদের আবার কারও কারও মনোনয়নপত্র বাতিলও হয়ে গেছে। সারা দেশে ২৯৫ আসনে বিএনপির ৬৯৬ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ২৫৭টিতেই ২-৫ জন করে প্রার্থী আছেন। একক প্রার্থী রয়েছে ৩৮ আসনে। বিএনপি ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো ২৪০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।
আসন নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে বিএনপির এখনও কোনো সমঝোতা হয়নি। শরিকদের মধ্যে নিবন্ধিত দলগুলো তাদের প্রতীকে প্রার্থিতা জমা দিয়েছে। যেসব দলের নিবন্ধন নেই, সেগুলো ধানের শীষের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ শরিকদের ৭০ আসনে ছাড় দেয়ায় বিএনপি শরিকদের চাহিদাও বড় হয়েছে। বিএনপি শুরুতে ২০ দলকে ৪০ আসনে ছাড় দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ১৫-২০ আসন দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
কিন্তু সমীকরণ পাল্টে যায় যখন, শেষ দিকে এসে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী তালিকা লম্বা হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে এখন পরিকল্পনামাফিক ১৫-২০ আসন দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
তাই ২০ দলকে কিছু আসনে কম দেয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। যদিও দলটির নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে এখনই মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি দুই জোটের শরিকদের ৬০টির বেশি আসন দেবে না এটি মোটামুটি নিশ্চিত।
দুদিন আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল এক সংবাদ সম্মেলনে ইঙ্গিত দিয়েছেন, ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টকে সর্বোচ্চ ৬০ আসন দেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে ২০ দলকে ৪০ আসন আর ঐক্যফ্রন্টের জন্য বরাদ্দ থাকছে ২০ আসন।
বিএনপি ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো ২৪০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ১০০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে গণফোরাম। জেএসডি জমা দিয়েছে ৬০ আসনে। নাগরিক ঐক্য ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ জমা দিয়েছে ৪০টি করে আসনে।
২৪০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও বিএনপির কাছ থেকে সম্মানজনক আসন পেতে দরকষাকষি করছে ঐক্যফ্রন্টের শরিক চার দল। নাগরিক ঐক্য ৯টি আসনে ধানের শীষ নিয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছে।
তবে চূড়ান্তভাবে এ দলটিকে সর্বোচ্চ দুটি আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে। ওই দুটি আসন হচ্ছে-মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২ আসন আর এসএম আকরামকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সারা দেশে দলীয়ভাবে ৪০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কাদের সিদ্দিকীর দলকে দুটি আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে।
কাদের সিদ্দিকীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। এ জন্য তার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকীকে টাঙ্গাইল-৪ কিংবা টাঙ্গাইল-৮ আসনে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। তার দলের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকীকে গাজীপুর-৩ আসনটি দেয়া হতে পারে।
এ ব্যাপারে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, দলীয়ভাবে আমরা ৪০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। তবে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপির সঙ্গে যেসব আসনে সমঝোতা হবে, সেগুলো রেখে বাকি প্রত্যাহার করা হবে।
ফ্রন্টের আরেক শরিক জেএসডি দলীয়ভাবে ৬০টি মনোনয়পত্র জমা দিয়েছে। তবে তাদের সর্বোচ্চ দুটি বা তিনটি আসনে ধানের শীষ দেয়া হতে পারে। জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে আর তানিয়া রবকে ঢাকার একটি আসন দেয়া হতে পারে।
দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতনকে কুমিল্লা-৪ আসনে ছাড় দিতে পারে বিএনপি। এ ব্যাপারে আবদুল মালেক রতন বলেন, ফ্রন্টের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বাকি আসনের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হবে।
গণফোরামের পক্ষ থেকে সারা দেশে শতাধিক আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রার্থীদের সর্বোচ্চ ১২-১৫ আসনে ছাড় দেয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে।
গণফোরাম ১৫ আসন পেলে দুই জোটের মধ্যে জামায়াতের ২৫ আসনের পর গণফোরামই সর্বোচ্চ আসন পাচ্ছে। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল নির্বাচন করছেন না। তার দল থেকে যারা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারেন, তারা হলেন-মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুব্রত চৌধুরী, রেজা কিবরিয়া, আবু সাইয়িদ প্রমুখ।
এ ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০-দলীয় জোটের শরিক ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আসন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এ নিয়ে কোনো সংকট হবে না।
সময় স্বল্পতার কারণে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত করা হয়নি। মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগে এ ব্যাপারে আমরা একটা সমঝোতায় আসতে পারব বলে আমরা আশা করি।