দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমান বিপজ্জনক হারে বাড়ছে।নানাউদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ হিসাবে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।
গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির খেলাপি ঋণের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবটি অনুমোদন করেছেন। তবে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। মূল হিসাব থেকে আলাদা করা (অবলোপন) ঋণ, বিশেষ বিবেচনায় নিয়মিত করা ঋণসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়বে। এরই মধ্যে খেলাপির কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বিদেশেও ব্যাংকিং খাত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপির কারণে বিদেশি ব্যাংকে এলসি খুলতে বাড়তি চার্জ দিতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসার খরচ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, প্রতি প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকার উদ্বিগ্ন নয়। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।
ব্যাংকিং খাতকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। তা না হলে হবে না। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামীতে নতুন সরকার এমন একজন শক্তিশালী অর্থমন্ত্রী দেবেন, যিনি ব্যাংকিং খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে নিজ থেকে প্রতিশ্রুতি দেবেন এবং তা কার্যকর করবেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৯৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। একে খুবই উদ্বেগজনক বলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, মোট ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ।
একই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৫৮ ভাগ।
বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ ভাগ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংক ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।
তার ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা বিতরণ ঋণের ২১ ভাগ। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত ৮৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাপক হারে ও নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট নিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
সে কারণে বর্তমানে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়ানোর আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এছাড়া ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় খুবই সামান্য। ঋণ অবলোপন আছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি বা মন্দ ঋণ প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বাড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে, এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি হওয়ায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রায় সবটাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
জনতা ব্যাংকে বড় ধরনের জালজালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। এসব টাকাও এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। অন্য দুটি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বছরের শুরুর দিক থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমোণ বাড়তে থাকে। ডিসেম্বরে এসে এর পরিমাণ কমে যায়। তখন ব্যাংকগুলো নিজ নিজ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য খেলাপি ঋণ আদায় বা নবায়ন করে এর পরিমাণ কমাতে থাকে।
এবার নির্বাচনের কারণে ব্যবসাবাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। যার কারণে ঋণ আদায় হয়েছে খুবই কম হয়েছে বলে জাম্না গেছে।