জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন এ দেশের মানুষের জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, আর সে লক্ষ্য অর্জনে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর হাত ধরেই এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করেছে। মাটি ও মানুষকে নিয়েই জাতির পিতা আজীবন কাজ করে গেছেন। আমাদের সংবিধানে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে গেছেন। তিনি চেয়েছিলেন সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে বৈষম্যহীন একটি সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে জাত-পাতের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। দেশের উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিমে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। নারী-পুরুষে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। গ্রাম আর শহরের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না। ‘কাউকে পেছনে ফেলে, কাউকে অর্থনীতির মূল স্রোতধারার বাইরে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা নয়’। এ নীতিতেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি তিনি সাজিয়েছিলেন এ দেশের মানুষকে বৈষম্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে। তিনি তাঁর কাজটি শেষ করে যেতে পারেননি। ঘাতকদের নির্মম বুলেট তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর আদর্শ বিলীন হয়নি। তাঁর আদর্শ সবসময়ই আমাদের সব ভালো কাজে অনুপ্রেরণার উৎস, আমাদের চির অনুসরণীয়। তাঁর আদর্শ এ দেশের মানুষের জন্য অম্লান হয়ে থাকবে অনন্তকাল পর্যন্ত, সূর্যের মতো দেদীপ্যমান।
বঙ্গবন্ধু সবসময় পরিকল্পিত উন্নয়নের চেষ্টা করে গেছেন। বাংলার মানুষের জন্য তাঁর দর্শন তিনি ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তুলে এনেছিলেন। তিনি জাতির উন্নয়নে দেশের গণমানুষের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে এনে তাঁর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মুখবন্ধে বলেছিলেন, ‘দেশের জনগণের পক্ষ থেকে কঠোর পরিশ্রম ও প্রয়োজনে যেকোনো ত্যাগের জন্য সর্বাত্মক অঙ্গীকার ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই, তা যত সুলিখিতই হোক না কেন, সঠিক বাস্তবায়ন হতে পারে না।’ তিনি মানুষের মুক্তির সেই দর্শনের কথা ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পুনরাবৃত্তি করেন। জাতিসংঘে প্রথমবার বাংলায় ভাষণ দেয়ার সময় বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আসুন, আমরা সকলে মিলে এমন একটি পৃথিবী গড়ে তুলি, যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও মানুষের সকল কষ্ট দূরীভূত হবে, বৈশ্বিক শান্তি অর্জিত হবে এবং মানবজাতির কল্যাণ রক্ষিত হবে।’ বঙ্গবন্ধু আমাদের যে পথ দেখিয়েছিলেন, যে দর্শন উপহার দিয়েছিলেন, সেটাই আজকে আমরা প্রতিধ্বনিত হতে শুনি জাতিসংঘে সর্বসম্মতিতে গৃহীত ২০৩০ সালের বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টতে (এসডিজি), যার মূল বক্তব্যই হলো ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়, কাউকে পেছনে ফেলে নয়’। আমরা অনুপ্রাণিত হই, গর্বিত হই, যখন দেখি, বঙ্গবন্ধুর স্বাপ্নিক আদর্শ বিশ্বদরবারে আজ সমাদৃত। আজ তাঁর দেখানো পথেই হাঁটছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হেঁটে আজ আমরা বাংলাদেশের সত্যিকারের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়তে দৃঢ়প্রত্যয়ী।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজির কথা বলতে গেলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে যায়। বর্তমান এসডিজির আগে প্রথমবারের মতো ২০০০ সালে সারা বিশ্বের জন্য জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজি সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছিল। এর আগে কখনো এত বড় পরিসরে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে সারা বিশ্বের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক একক উন্নয়ন এজন্ডা নেয়া হয়নি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, তত্কালীন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশকে এ বৈশ্বিক এজেন্ডায় সম্পৃক্ত করেন। কিন্তু ২০০২ থেকে ২০০৬ মেয়াদে দেশের পরিচালনা উন্নয়নমুখী ছিল না, তাই এমডিজি নিয়েও দেশে বিশেষ কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরায় দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার নেয়ার পর তিনি এমডিজির আলোকে লক্ষ্যভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এমডিজি অর্জনের লক্ষ্যে ‘রূপকল্প-২০২১’ ও ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’র মাধ্যমে দেশকে প্রস্তুত করেন। তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে এমডিজির আটটি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনেই বাংলাদেশ সফলতা দেখায়।
আমরা দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগে, ২০১৩ সালেই অর্জন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিই। দারিদ্র্য হ্রাসকরণ-সংক্রান্ত এমডিজি-১ লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বে অগ্রগামী ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক ‘বিশেষ স্বীকৃতি’ লাভ করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশকে এজন্য ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’ও প্রদান করে। একই কারণে বাংলাদেশ ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে। এমডিজির চতুর্থ লক্ষ্য, শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে ২০১০ সালেই আমরা ২০১৫-এর লক্ষ্য অর্জন করি। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘ ‘এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০’-এ ভূষিত করে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার-সংক্রান্ত এমডিজি-৪ ও এমডিজি-৫-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করেছিল। ফলে বাংলাদেশের জন্য এ দুটি লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হয়েছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে আরেকটি ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করা হয়। নারী শিক্ষায় ব্যাপক সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ হতে ‘ইউনেস্কো পিস ট্রি’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। এমডিজি-৫-এর আওতায় নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর ভূমিকার জন্য ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয় এবং ইউএন-উইমেনের পক্ষ থেকে ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ঘোষণা করা হয়। এমডিজি-৭-এর লক্ষ্য অনুযায়ী, পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সংক্রান্ত সাফল্যের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের জন্য ইউএনইপি হতে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এমডিজির সব লক্ষ্য অর্জনে সফলতা দেখানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল। তাই জাতিসংঘের ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে এমডিজি অর্জনে সফল ১৮টি দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। এমনটি সম্ভবপর হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে। এমডিজি অর্জনকে প্রধানমন্ত্রী সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই আমরা এসব লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে গিয়েছি। এ সময়ে সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১১-১৫) মাধ্যমে পরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল বলেই এমডিজির আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এ সফলতা দেখাতে পেরেছে। আর আজ তাই আমরা বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যেমন সফলতা আমরা দেখিয়েছিলাম, তেমনি আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও কাজ করে যাচ্ছি। এমডিজিতে অনেক আর্থসামাজিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও অনেকগুলো অর্থনৈতিক বিষয় অনুল্লেখিত ছিল। অর্থনৈতিক নিয়ামকগুলোর সঙ্গে পরিবেশগত বিষয়াদি ও জলবায়ু পরিবর্তনকে এসডিজিতে বিস্তারিতভাবে নিয়ে আসা হয়েছে। এসডিজির এসব নতুনত্বকে বিবেচনায় নিয়েই আমরা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সাজিয়েছি এবং সে অনুযায়ী আমরা গত তিন বছর নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। এসডিজি বাস্তবায়নে সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নিয়মিত তদারকি করে যাচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রয়োজনীয় সব নীতি কাঠামো প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে। এসডিজি অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য এটুআই হতে ডিজিটাল অ্যাপস ‘এসডিজি ট্র্যাকার’ তৈরি করা হয়েছে, যার সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সংযুক্ত আছে সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তর। এর আলোকে আমরা গত বছর জাতিসংঘে আমাদের আংশিক অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছিলাম আর এ বছর পরিকল্পনা কমিশন একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রণয়ন করছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পরিচালনায় গত ১০ বছরে দেশ বদলেছে, গতিশীল হয়েছে অর্থনীতির চাকা, আর তাই নজরকাড়া উন্নতির মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হাত ধরেই আমরা ক্রমে এসডিজির অধিকাংশ অভীষ্ট লক্ষ্যের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছি। এক দশকে আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ২০ লাখ কোটি টাকারও বেশি উন্নয়ন করেছি। বড় ধরনের পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুরুতে কিছুটা সক্ষমতার অভাব থাকলেও এখন যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা শতভাগ সক্ষমতা অর্জন করেছি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি টেকসই গতিশীলতার মধ্যে এসেছে। এ প্রকল্পগুলো যখন শতভাগ বাস্তবায়ন হবে, তখন বাংলাদেশ হবে একটি সমৃদ্ধ দেশ। এর প্রভাব এরই মধ্যে পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচকে আমাদের সাম্প্রতিক অগ্রগতি দেখলে দেশের মানুষ তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাবে।
এসডিজির প্রথম অভীষ্ট: দারিদ্র্য বিলোপ— এক্ষেত্রে লক্ষ করলে দেখা যায়, ২০১০ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার যেখানে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ও চরম দারিদ্র্যের হার ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল, সেখানে ২০১৬ সালে তা এসে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৮ সালে দারিদ্র্যের হার আরো কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে। আমাদের সরকারের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সুবিন্যস্ত ও গভীরতর করায় আমরা দেশের দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে পেরেছি। এসডিজির দ্বিতীয় অভীষ্ট: ক্ষুধা মুক্তি-এর পুষ্টি সূচকের ক্ষেত্রে শিশুদের খর্বিত বিকাশ ২০১৬ সালে ছিল ৩৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, তা কমে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। কৃষি খাতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে, চাল উৎপাদনে আজ বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের রোল মডেল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ধানের মোট উৎপাদন ছিল ৩৩ দশমিক ৮০ মিলিয়ন টন, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ২৮ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ২০০৫-০৬ সালের ৩ দশমিক ১ টন থেকে ২০১৭-১৮ সালে ৪ দশমিক ২ টনে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া ২০১৫-১৬ সালে আবাদযোগ্য কৃষিজমির পরিমাণ যেখানে ছিল ৫৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬-১৭ সালে ৫৮ দশমিক ১৯ শতাংশ হয়েছে। এ সফলতা অর্জিত হয়েছে আমাদের সরকার সময়মতো কৃষকদের মাঝে সার, উন্নত বীজ, কৃষিঋণ বিতরণ, সেচের জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং অন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির জন্য।
এসডিজির তৃতীয় অভীষ্ট: সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ-এর ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার ২০১৬ সালে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে ছিল ৩৫ জন, যা ২০১৭ সালে কমে ৩১ জন হয়েছে এবং নবজাতক মৃত্যুহার ২০১৬ সালে প্রতি হাজারে ১৯ জন থেকে কমে ২০১৭ সালে ১৭ জনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মাতৃ মৃত্যুহার ২০১৬ সালে প্রতি হাজারে ছিল ১৭৮ জন, যা ২০১৭ সালে কমে হয়েছে ১৭২ জন। এসডিজির চতুর্থ অভীষ্ট: গুণগত শিক্ষা-এর ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষায় ২০১৬ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ (ছেলে ২২ দশমিক ৩ শতাংশ ও মেয়ে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ)। আমাদের সরকার কারিগরি শিক্ষায় জোর দেয়ায় কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ২০০৬ সালের ২ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে, অর্থাৎ এমডিজি সময়কালে ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়, যা ২০১৮ সালে এসে ১৭ শতাংশ হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বিদেশে আমাদের প্রেরিত কর্মীদের দক্ষতায়ও। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, মালয়েশিয়ায় ম্যানেজারিয়াল পদে নিযুক্ত বিদেশী কর্মীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশই বাংলদেশী। এসডিজির পঞ্চম অভীষ্ট: জেন্ডার সমতা-এর ক্ষেত্রে জেন্ডার ক্ষমতায়নে বর্তমানে বাংলাদেশের বৈশ্বিক র্যাংকিং ৪৭তম। সামগ্রিক বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশ মোট জেন্ডার পার্থক্যকে প্রায় ৭২ শতাংশে নামিয়ে এনে ২০১৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছে।
বিগত দিনে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বীকৃতির অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পানিসংক্রান্ত এসডিজির ষষ্ঠ অভীষ্ট: নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের জন্য জাতিসংঘের পানি সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের সদস্য করা হয়েছে। ২০১৭ সালের হিসাবমতে, বর্তমানে আমাদের মোট জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে এবং ৭৬ শতাংশ নিরাপদ স্যানিটেশনের সুবিধা পাচ্ছে। এসডিজির সপ্তম অভীষ্ট: সাশ্রয়ী, দূষণমুক্ত জ্বালানি-এর ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত, যা বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ। এর বিপরীতে বিশ্বব্যাপী ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনসংখ্যার হার ছিল ৮৭ শতাংশ।
এসডিজির অষ্টম অভীষ্ট: শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য বেশ ভালো। গত তিন বছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে) বাংলাদেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশেরও বেশি, আর গত বছর প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। জিডিপির অভূতপূর্ব অর্জনে যুক্ত হয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে নিম্নগতি। ফলে মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে ঊর্ধ্বমুখী ধারা শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময় সার্বিক বেকারত্ব পরিস্থিতির উন্নতিও লক্ষণীয়; ২০১০ সালের ৪ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে এ হার ৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৫-০৬ সালে যেখানে কর্মসংস্থান ছিল ৪৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন, তা ২০১৬-১৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক ৮ মিলিয়নে। গত এক দশকে ১ কোটি ৩৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৫ অর্থবছরে প্রবাসে গমনকারী বাংলাদেশী কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৬১ হাজার; গত দুই অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ ৯০ হাজার কর্মী বিদেশে গমন করেন। প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২০১৫-১৬ সালে ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। প্রবাসী কর্মসংস্থানের ঊর্ধ্বমুখী গতিধারার কারণে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর আমাদের রেমিট্যান্স ১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। ২০১৬ সালে আমাদের বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৮ সালে বেড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এসডিজির নবম অভীষ্ট: শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামো-এর ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে শিল্প, বিশেষত ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমরা জিডিপিতে ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান অর্জন করেছি। মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ২০১৭ সালেই প্রায় ৯২ দশমিক ৫৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ছিল ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা। চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তিও এখন অনেকের কাছেই পৌঁছে গেছে, আর আমরা পঞ্চম প্রজন্ম দেশে নিয়ে আসার দ্বারপ্রান্তে রয়েছি। দেশের ৬৪টি জেলায় ১১৪টি উপজেলা থেকে ১ হাজার ১০৪টি ইউনিয়নে প্রায় আট হাজার কিমি অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপন করা হয়েছে। সারা দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক হচ্ছে, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য তৈরি হচ্ছে ও বিদেশে সেবা রফতানি হচ্ছে।
এসডিজির দশম অভীষ্ট: অসমতা হ্রাস-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের ১৫০টিরও অধিক প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান আছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমাদের সরকার পরিকল্পিত অর্থনীতিতে Redistributive Approach-এর নীতি অনুসরণের মাধ্যমে সমতা অব্যাহত রাখায় সচেষ্ট আছে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে বৈষম্য অনেক কমে এসেছে। সম্প্রতি World Economic Forum (WEF) বিশ্বের ৭৪টি সম্ভাবনাময় অর্থনীতির ওপর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বিষয়ে সমীক্ষা করে; সেখানে আমরা বাংলাদেশকে ৩৪তম স্থানে দেখতে পাই। যেখানে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ৬২তম, পাকিস্তান ৪৭তম ও শ্রীলংকা ৪০তম। এসডিজির একাদশ অভীষ্ট: টেকসই নগর ও জনপদ’কে কেন্দ্র করে বড় শহরগুলোয় বিশেষত ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য পরিবহন, রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, পয়োনিষ্কাশন, ভূ-উপরিস্থিত পানি সরবরাহ ইত্যাদি নানা খাতে অনেকগুলো বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
এসডিজির দ্বাদশ অভীষ্ট: পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন, এসডিজির ত্রয়োদশ অভীষ্ট: জলবায়ু কার্যক্রম, এসডিজির চতুর্দশ অভীষ্ট: জলজ জীবন এবং এসডিজির পঞ্চদশ অভীষ্ট: স্থলজ জীবনসংক্রান্ত সবগুলো পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনেই সরকার সচেষ্ট আছে। সব প্রকল্প ও কার্যক্রমে জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টিকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। এসডিজির ষোড়শ অভীষ্ট: শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান অর্জনের জন্য সরকারের সব প্রতিষ্ঠান’কে শক্তিশালী করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য দেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তাদের জন্য বসবাসের জায়গা, নিরাপত্তা, খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাই তো যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম তাঁকে আজ বিশ্বের কাছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এসডিজির সর্বশেষ অভীষ্ট: অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে যেখানে ২০১৬ সালে প্রকৃত উন্নয়ন ঋণসহায়তা ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮ সালে তা বেড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের মতো একটি সমন্বিত ও বহুমুখী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে দেশকে অনেক দূর নিয়ে এসেছেন। তাঁর হিরণ্ময় নেতৃত্বে আমরা গত ১০ বছরে জনবান্ধব উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছি, যার মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দারিদ্র্য ও অসমতার হ্রাস। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতিমালা, বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ তা সুবিন্যস্ত করে এর গভীরতা বাড়ানো, অনগ্রসর অঞ্চলের উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণের জোগান, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান, কর ব্যবস্থার গণমুখী সংস্কার প্রভৃতি নীতি মানুষে মানুষে বৈষম্য, গ্রাম-শহরের পার্থক্য, অঞ্চলভিত্তিক অসমতা হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই আমরা ২০১৫ সালের আগেই এমডিজি অর্জন করেছি। আর তাই যাঁকে বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস ২০১৮ সালে বিশ্বের ২৬তম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে মনোনীত করেছে; তাঁর হাত ধরেই আমাদের সরকারের গৃহীত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে ২০৩০ সালের আগেই বাংলাদেশ এসডিজির সব লক্ষ্য অর্জন করে সারা বিশ্বের উপরে থাকবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক: মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সূত্র বণিকবার্তা