বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে অতিমাত্রায়। যার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এতে কমে যাচ্ছে টাকার মান, যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর প্রচণ্ড চাপ ফেলেছে।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি চলতি হিসাব পরিচালনা করে। এতে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যেতে পারে।
আর ওই চাপ মোকাবেলায় করণীয় বের করতে একটি সমীক্ষা চালাতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ২৮৯ কোটি ডলার। নভেম্বরে এই ঘাটতি আরও বেড়ে ৩৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৪২ কোটি ডলার।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি ডলার। তার আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ হিসাবে কোনো ঘাটতি ছিল না। উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১২৪ কোটি ১০ লাখ ডলার।
এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৩৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি হয়েছিল ৯৭৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের হিসাবে দীর্ঘ সময় ধরে ঘাটতি চলতে থাকলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাবে। বেড়ে যাবে ডলারের দাম। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয় বাড়বে।
তখন পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি আমদানি প্রধানদেশ, টাকার মান কমে যাওয়া ও আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাতগুলোয় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় কমে গেছে। কিন্তু যে হারে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমেছে, সে হারে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমেনি। বরং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক অনুদান কমেছে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে বৈদেশিক অনুদান বেড়েছিল প্রায় ১০২ শতাংশ।
রোহিঙ্গাদের অনুকূলে অর্থছাড় বাড়ায় এই খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু এখন অনুদান কম আসায় এ খাতে আগের মতো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় কমছে না। বরং বাড়ছে। সরকারের হিসাব থেকে এসব অর্থ খরচ হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই অক্টোবরে প্রবাসীদের আয় বেড়েছে ১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়লেও অক্টোবরে কমে গেছে। গত অর্থবছরের অক্টোবরে রেমিটেন্স বেড়েছিল ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ।
এদিকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রফতানি আয়ে নেতিবাচক থাকলেও অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রফতানি আয় বেড়েছিল ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়েছে সাড়ে ১৮ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে বেড়েছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবরে বেড়েছে সাড়ে ৩০ শতাংশ।
এদিকে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধারা চলমান রয়েছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও গড়ে বেড়ে যাচ্ছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল সাড়ে ২৮ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেস্বরে এ ব্যয় বেড়েছিল পৌনে ১৮ শতাংশ। চলতি বছরের একই সময়ে বেড়েছে ২৪ শতাংশের বেশি।
এদিকে আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয়ের মধ্যকার ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল ৩৬৫ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি বেড়ে ৩৮৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিয়োগ খাতে চলছে মন্দা। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ এসেছিল ১৫৯ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৭৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছিল ৩০ কোটি ডলার। এবার এসেছে ৩৩ কোটি ডলার। শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৬ কোটি ডলার।
এবার এসেছে ৩ কোটি ডলার। উল্টো দেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ তুলে নেয়া হচ্ছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি। প্রতি তিন মাস পর গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে হচ্ছে।
এছাড়া ভ্রমণ ও চিকিৎসা খাতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এর একটি অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। গত বছরের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৯৪ কোটি ডলার। ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৯ কোটি ডলারে।