প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা না মেনে এখনও অতিরিক্ত সুদ আদায় করছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক গুলো। এক অঙ্কে সুদহার নামিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে তা কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন করেনি ব্যাংক। দশ শতাংশের বেশি সুদ আদায় করছে দেশি-বিদেশি ২৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংকের আমানতের সর্বোচ্চ সদুহার হবে ৬ শতাংশ ও ঋণে ৯ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এমনই প্রতিশ্রুতি দেন বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপকরা।
ব্যাংকগুলো এটি বাস্তাবায়নে সরকারের কাছ থেকে করপোরেট করহার কমানোরসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখনও ১০ শতাংশের উপরে ঋণের সুদ আদায় করছে বেশিরভাগ ব্যাংক।
চলতি বছরের জুলাই থেকে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেয়ায় ঘোষণা দিয়েছিল ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন 'বিএবি'। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ ঘোষণা দেন তারা। তাই যেসব ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামেনি। তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করেছেন।
এমনকী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) নির্দেশনাও লঙ্ঘন করছে। স্প্রেড ৪ শতাংশীয় পয়েন্টের নিচে রাখার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অক্টোবর মাস শেষে ২৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের বেশি আদায় করছে। আর ৩৬টি ব্যাংকের স্প্রেড ৪ শতাংশীয় পয়েন্টের উপরে রয়েছে। অক্টোবর শেষে ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। এর মধ্যে অনেক ব্যাংক এখনো স্প্রেড নিচ্ছে ৮ শতাংশের উপরে।
তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপকে কেন্দ্র করে সুদহার বাড়তে থাকায় তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৩০ মে এক নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন প্রকার ঋণের সুদহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করছে।
ঋণের সুদহার অযৌক্তিক মাত্রায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। তাই সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে ভোক্তা ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে স্প্রেড ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আগে যা ৫ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গড়ে ১০ শতাংশের বেশি ঋণের সুদ নিচ্ছে ২৯ ব্যাংক। এর মধ্যে বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ঋণের সুদহার ১০ দশমিক ১২ শতাংশ, বেসরকারি এবি ব্যাংকের ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সিটি ব্যাংকের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, আইএফআইসি ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ, সীমান্ত ব্যাংক ১০ দশমিক ১২ শতাংশ, ইস্টার্নে ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ, এনসিসির ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংকের ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ডাচ্-বাংলায় ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ডে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ, এক্সিমের ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ, প্রিমিয়ারে ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ, ফাস্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যমুনা ব্যাংকের ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ১৩ দশমিক ০৭ শতাংশ, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, মেঘনা ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ, ফার্মাস ব্যাংক ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংক ১২ দশমিক ০৬ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, এরআরবি গ্লোবাল ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও মধুমতি ব্যাংক ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে গড় সুদ নিয়েছে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। বিদেশি খাতের এ ব্যাংকটির স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ডাচ্ বাংলা সুদ দিয়েছে ২ দশমিক ৬২ শতাংশ আর ঋণে নিয়েছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ। ব্যাংকটির স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংক আমানতের বিপরীতে সুদ দিয়েছে ৫ দশমিক ০৮ শতাংশ। আর ঋণের বিপরীতে নিয়েছে সুদহার ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। ব্যাংকটির স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
গত অক্টোবর শেষে ব্যাংকগুলো গড়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে আমানত নিয়েছে। আর ঋণ বিতরণ করেছে ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুদে। এতে করে স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশীয় পয়েন্ট।
অক্টোবর রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের ২ দশমিক ৪০ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলো নিজেরাই সরকারের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমানত ৬ শতাংশ ও ঋণে ৯ শতাংশে সুদহার নামিয়ে আনবে। এ জন্য সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও নিয়েছে।
যেহেতু ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় এক অঙ্কে সুদহার নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে তাই এটি বাস্তবায়ন করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে দেখব, কেন তারা সুদহার নামিয়ে আনতে পারছে না। যদি যৌক্তিক কোনো কারণ না থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।