শীতকালের নাম শুনলেই মন ও শরীর ঠান্ডার ভয়ে কাপন শুরু করে দেয়। লেপ-কাথার উমের আড়াল থেকে নিজেকে কিছুতেই বের করতে মন চায় না। উ হু হু ...এই বুঝি দাতে দাত লেগে এল! শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠলেই দেখা যায় দিনের মধ্যভাগ।তারপরও কাজ করতে গেলে যেন মনে হয় হাত লেগে আসলো বুঝি!
যদিও কেউ কেউ শীতকালকে অলস কালও বলে থাকে।আবার কারও থাকে ঋতু পছন্দের তালিকার শীর্ষে। তবে ভৌগোলিক কারণে আমাদের দেশে অন্য শীতপ্রধান দেশের তুলনায় কমই শীত পড়ে থাকে । ইউরোপ-আমেরিকা বা অন্যান্য শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীতকালে প্রচুর বরফ পড়ে । সেখানে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের অনেক নিচে; অনেক মানুষ মারাও যায়-জীবনযাত্রাও হয়ে পড়ে স্থবির । শুধু ইউরোপ-আমেরিকা বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেই নয়, আমাদের এশিয়ার অনেক দেশেই চলে হাড়-কাঁপানো শীতের দাপট।সে তুলনায় বাংলাদেশে শীত অনেকাংশে কম। কখনও কম কখনও বা একটু বেশি! তবে তা সহ্য করে আমরা শীতকে বেশ উপভোগ করি।
পৌষ ও মাঘ এ দুই ঋতু মিলে হয় শীতকাল। পৌষ মাসটায় শীত বেশী পরলেও মাঘ মাসে তেমন পড়ে না।কথায় আছে-‘ মাঘের শীত বাঘের গায়’! অর্থাৎ, শীতকে আমরা মাঘ মাসেই বিদায় বলে দেই ।
প্রাকৃতিক লীলাভূমির এ দেশে শীতও যেন আসে নানা বৈচিত্র নিয়ে ।তবে গাছে গাছে রুক্ষ পাতা-ডালপালা আর উত্তরের কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার হাড়কাপানো শীতের মাঝেও চলে যেন উৎসব। সবজির খেতে ভরপুর সবজি ও বছরের সঞ্চিত অর্থটাকে পুজি করে ,আয়েশ করে কাটিয়ে দেওয়া হয় শীতকালটা।
আর এই আয়েশের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হল ,পিঠার স্বাদে মেতে ওঠা। আমাদের দেশে প্রায় দেড়শর-ও বেশী পিঠা প্রস্তুত হয়।বিভিন্ন ঋতু বা উৎসবে নানা ধরণের পিঠা তৈরি করা হয়। আমাদের বাংলাদেশে নানান স্বাদের নানান পিঠা তৈরি হয়ে থাকে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলঃ চিতই পিঠা,চাঁদপোয়া, মালপোয়া,দুধ চিতই, পাক্কন, তেলের পিঠা, ভাপা পিঠা, ,পাটিসাপটা,নারকেল পুলিসহ নানা রকমের নানা স্বাদের পিঠা।
শীতকালীন এসব পিঠা খাওয়া আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য, সে জন্যই বহুকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে শীত এলেই তৈরি হয় বিভিন্ন রকমের মজার মজার পিঠা। হেমন্তের শেষেই শীত হওয়ায় পিঠার উৎসব এর সবই তৈরি হয় কৃষকের নতুন ধানের চালে। সঙ্গে যোগ হয় খেজুরের রস ও গুড়। আত্মীয়-স্বজন একজন আরেকজনের বাড়িতে বেড়াতে যান ঠিলাভর্তি পিঠা নিয়ে। নতুন জামাই এলেও তাকে দেয়া হয় নতুন চালের পিঠা। কন্যার বাড়িতেও পাঠানো হয় পিঠা-পুলির হাঁড়ি। শিল্প-সাহিত্যেও পিঠার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। 'আইলোরে আইলোরে বাংলায় পৌষ-মাঘ মাস, বাতাসে ছড়ায় কতো পিঠা পুলির সুবাস, শীতকাল আইলোরে সারা বাংলায়, পিঠা খাওয়ার ধূম পড়লোরে......'
শীতকালীন এ সব পিঠা আবহমান গ্রাম-বাংলায় ঐতিহ্য নিয়ে চললেও শহুরে ব্যস্ত জীবনে এমন মজার িপিঠার স্বাদ পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব! আর এই অপারগতাকেই সুযোগ বানিয়ে ব্যবসা করছে অনেক খুদে ব্যবসায়ীরা।এলাকার রাস্তার পাশে, অলিগলিতে বা বাজারের কোন এক ছোট জায়গাতেই প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে বসে যায় পিঠার দোকান দিয়ে।শহরের অনেক জায়গায় পিঠা ঘর থাকলেও এসব দোকান থেকেই পিঠা খেতে উপভোগ করে পিঠা পাগলরা।শহরের প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই তৈরী এসব পিঠার থেকে কয়েকটি পিঠার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল পাঠকদের উদ্দেশ্যে।
চিতই পিঠাঃ নানান কাঠামোর সাচেঁ(পিঠা তৈরির মাটির পাত্র) চালের গুড়োর সাথে লবণ-পানি মিশিয়ে তৈরি হয় এই মজার পিঠা।সাদা গোল বা লম্বা এ পিঠা শহরের প্রায় প্রতিটি মোড়েই বিক্রি হয়।সাথে মরিচ ভর্তা, সরিষা ভর্তা ,কালোজিরা ভর্তা বা ধনেপাতা ভর্তার সাথে এ পিঠা যেন স্বর্গের সুধা।পাচ টাকা দামের এই পিঠা খাওয়ার সময় ঝালে হা হা করলেও মনে হবে আরও খাই ,আরও চাই।যদিও গ্রামবাংলায় প্রায় অঞ্চলেই গোশতের ঝোল বা শীতকালীন খেজুর রসে ভিজিয়ে খাওয়া হয় এই পিঠা।শহরের প্রায় এলাকাতেই এই পিঠার পসরা সাজিয়ে বসে খুদে ব্যবসায়ীরা।
ভাপা পিঠাঃ ভাপা পিঠারে এ এ এ হাহ্..... - হাজারও গান ,কবিতা বা লেখনির মাঝেই ভর করে এ পিঠা বেচে আছে বাংলায়। গ্রাম বাংলার অতিথি আপ্যায়নে বা নিজেদের জন্য এর তৈরি হলেও ঢাকাসহ প্রায় সকল শহরেই শীত আসতেই রাস্তার পাশে ধুম পড়ে যায় এ পিঠা খাওয়ার উৎসবে। চালের গুড়োর সাথে আখের গুড় আর নারকেলের সমন্বয়ে এক অদ্ভুদ উপায়ে ভাপ দিয়ে তৈরি হয় এ পিঠা। ভাপ দিয়ে তৈরি হয় বলে এ পিঠার নাম হয়ত ভাপা পিঠা।বাঙ্গালীর ঐতিহ্যের অসাধারন মজার এ পিঠা শহরে আকার ভেদে ৫-১০ টাকা করে বিক্রি করে অনেক খুদে ব্যবসায়ীরা।
তেলের পিঠাঃ গরম তেলের মাঝে পানি ,চিনি/গুড়, চালের গুড়ো ও অন্যান্য উপকরনের সমন্বয়ে ভাজা সুস্বাদু পিঠাকেই তেলের পিঠা বলা হয়। অঞ্চল ভেদে যদিও একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। কোথাও একে বলে চান্দের পিঠা, কোথাও আবার বলে আন্দাশা পিঠা !তবে গরম তেলে ভাজার পিঠাটা তেলের পিঠা নামেই বেশি পরিচিত শহরে। প্রায় অনেক ছোট দোকানেই চিতই পিঠার পাশাপাশি এ পিঠাও বিক্রি করে খুদে ব্যবসায়ীরা।দাম সাধারণত ৫ টাকাই হয়,তবে আকার ভেদে কোথাও ১০ টাকাও রাখা হয়।