সম্প্রতি সংঘটিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ব্যাংক জালিয়াতি কঠোর হাতে দমনের উদ্যোগ নিয়েছে সদ্য নির্বাচিত নতুন সরকার।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বছরের শুরুতেই এ সংক্রান্ত একটি চিঠি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে।
চিঠিতে ব্যাংক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা, কর্মচারী, ঋণগ্রহীতা এবং দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
চিঠির শুরুতে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত বিষয়াদি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, বিদেশে অর্থ বা পুঁজি পাচার রোধ করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের বাইরে সম্পদ গচ্ছিত রাখা প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়। পাশাপাশি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্র ২০১৫-১৭ বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার জন্য বিভিন্ন পক্ষের হস্তক্ষেপই দায়ী। বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ব্যাপক হস্তক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাকে তার মতো করে চলতে দিলেই সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হয়ে যাবে। আর ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।
চিঠিতে বলা হয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কার্যকর এবং শক্তিশালী করতে হবে। দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নে স্থায়ী এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১০ বছর আগে ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
বিশাল অঙ্কের এই খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে আলোচনায়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা-সিপিডি তথ্য দিয়েছে, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩ সপ্তাহ আগে ৯ নভেম্বর ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা কী করব’ শীর্ষক এক সংলাপে এ তথ্য দেয় সিপিডি। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওই তথ্যকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দেন।
ব্যাংক জালিয়াতি বন্ধে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দেয়া চিঠি প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের
বখতিয়ার আহমেদ বলেন, এগুলো খুবই ভালো প্রস্তাব। কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন হবে যদি সরকারের সদিচ্ছা না থাকে। কারণ সরকারের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া বড় ঋণখেলাপি ধরতে পারবে না ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সততা এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতাও অত্যাবশ্যক। তা না হলে প্রস্তাবগুলো উদ্যোগের মধ্যেই সীমিত থাকবে, কার্যকর হবে না।
ব্যাংক খাত সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংক খাতের সেবা সম্প্রসারণ, দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ অনুমোদন ও অর্থছাড়ে দক্ষতা এবং গ্রাহকের প্রতি ব্যাংকের দায়বদ্ধতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) সম্প্রসারণ, আর্থিক খাতের লেনদেনে ডিজিটালাইজেশন বাড়ানো এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অগ্রগতিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুর রহমান বলেন, এসব উদ্যোগ কার্যকর করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে হবে। তা না হলে এগুলো কার্যকর হবে না।
প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় বলা হয়, ‘ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নে টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি নির্ণয় করা হবে।
বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিচক্ষণতার সঙ্গে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ঋণ অনুমোদন ও অর্থছাড়ে দক্ষতা এবং গ্রাহকের প্রতি ব্যাংকের দায়বদ্ধতা পরিবীক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নেবে।’