ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ এখন ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। আর একবছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ খেলাপিদের সামাজিক বয়কট চান সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া তাদের আইনি ভাবে ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো সংস্কারের পরামর্শ এসেছে।
বুধবার বিকেলে খেলাপি ঋণ কমাতে একটি পরামর্শক সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে এসব সুপারিশ ওঠে আসে। তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক-এমডি ও প্রধান নির্বাহীরা এসব পরামর্শ তুলে ধরেন। এমডিদের এই পরামর্শের সঙ্গে একমত আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইনজ্ঞরাও বলছেন, দেশে খেলাপি ঋণ কমাতে চাইলে শক্ত পদক্ষেপ দরকার। তবে সবই নির্ভর করবে সরকারের মনোভাব ও সিদ্ধান্তের ওপরে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কঠোর ভাবে কোন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে না।
যেখানে বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বিএম খায়রুল হকসহ কমিশনের সব সদস্যরা ও তফসিলি ব্যাংকগুলোর এমডিরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে এতে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারও উপস্থিত ছিলেন। সাড়ে তিন ঘণ্টা চলে এই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক।
সভায় যোগ দেওয়া সূত্রগুলো বলছে, সভায় ব্যাংকিং খাতের হয়ে অংশ নেওয়া এমডিরা খেলাপি ঋণ বাড়ার বাস্তব দিকগুলো তুলে ধরেন। কেন ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না সেটিও তারা জানান। এজন্য এমডিরা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় করতে হলে সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে এমন চর্চা রয়েছে। ঋণ খেলাপিরা ব্যাংকের দায় পরিশোধ করবেন না, কিন্তু বিলাসি জীবন যাপন করবেন সেটি যাতে না হয়। তাদের পাসপোর্ট নবায়ন আটকে দেওয়া যেতে পারে। দেশের বাইরে যাতে ভ্রমনে যেতে না পারেন। এমনকি দেশের ভেতরে প্লেন টিকিট যাতে কিনতে না পারেন।
বৈঠকে আলোচনা হয়, ঋণ খেলাপিদের সন্তানদের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আটকে দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া এসব ব্যক্তি যাতে গাড়ি কিনতে না পারেন, বাড়ি কিনতে না পারেন সেটি কিভাবে করা যায় ভাবার সময় এসেছে।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আজকে আমরা খেলাপি ঋণ নিয়ে সভাটি হয়েছে। এখানে খেলাপি ঋণ কিভাবে কমানো যায় সেটি ওঠে এসেছে। আলোচনা শুরু হলো। আলোচনা চলবে।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বিদ্যমান আইনগুলো যদি সংস্কার ও যুগপোযোগী করার দরকার পরে সেটি করা হবে। আমরা নিজেরাও পর্যবেক্ষণ করছি এবং ব্যাংকার আজ জানিয়েছে, ব্যাংক কোম্পানী আইন, অর্থ ঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইনের কিছু বিষয় সংস্কার দরকার। কারণ অনেকেই ব্যাংকের দায় পরিশোধ না করে আদালতে চলে যাচ্ছেন। সেখান থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসছেন।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, এখানে কোন পক্ষ যাতে ক্ষতিগ্রস্থা না হয় সেটি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। ব্যবসায়িরা যাতে হয়রানি না হন। তবে ইচ্ছেকৃত খেলাপিদের ধরা হবে। ইচ্ছেকৃত খেলাপি কিভাবে সনাক্ত করা হবে প্রশ্নে এই কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেন না কিন্তু বিলাসি জীবন যাপন করছেন এরাই ইচ্ছেকৃত খেলাপি। ব্যবসা করেন ভালো কিন্ত ঋণ পরিশোধ করেন না তারা ইচ্ছেকৃত খেলাপি।
তফশিলি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আজকের বৈঠকের উদ্দেশ্য একটাই। খেলাপি ঋণ। এটি সরকার চাচ্ছেন কমাতে। আমরা তাই চাই। কোন উপায় নেই। এজন্য পরামর্শক সভা হলো। এরপর আরো সভা হবে। আমরা আমাদের পরামর্শ তুলে ধরেছি। আইনি সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আইন কমিশন, আইন মন্ত্রণালয়, বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল এর কার্যালয় সবাই এক সঙ্গে কাজ করা হবে। বৈঠক করা হবে।
তিনি বলেন, টাকা নিলে ফেরত দিতে হবে এই মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ঋণ খেলাপিদের সামজিক ভাবে কিভাবে ঠেকানো যায় সেগুলো নিয়ে আলাপ হয়েছে। তবে বিস্তারিত এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে শুরু হলো একটি পদক্ষেপ। আমরা আশাবাদি, নিশ্চয়ই একাট পথ বের করা যাবে। এর আগে শুরু হয়নি।
সূত্রগুলো বলছে, নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। তার ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে তিনি এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক বরেন সরকারি বেসরকারি তফশিলি ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে। তারই আলোকে আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি পরামর্শক সভা ডেকেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা যায়, বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষেও বেশ কিছু সুপারিশ ওঠে এসেছে। ঋণ পুনঃতফশিলিকরণসহ মন্দ ঋণ বেচাকেনার পদ্ধতি চালুর বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসা হয়।
তবে বৈঠকের একটি সূত্র বলছে, খেলাপি ঋণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ, সামাজিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে আইন প্রণয়ন করা কঠিন কিছু নয় মর্মে আলোচনা হয়। তবে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এসময় জানান, যত আলোচনাই করা হোক, সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা না থাকলে কার্যকর কিছু করা যাবে না। আইন কমিশনের কথা সরকার আমলে নিবে কিনা সেটিও স্পষ্ট নয়।