কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী না হলে কর্পোরেট গভর্নেন্স ব্যর্থ হবে
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০২-২৫ ২০:৫৪:৪৬
বিশ্বব্যাংক ভারতের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড.জুনায়েদ কামাল আহমাদ বলেছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার চর্চা জোরদার করতে রেগুলেটরী ফ্রেমওয়ার্ক শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী হওয়া জরুরী। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করার মাধ্যমে নজরদারী আরও না বাড়লে কর্পোরেট গভর্নেন্স ব্যর্থ হবে। নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে সুশীল সমাজেরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
আজ সোমবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ১৮তম নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচার ‘ইথিকস ইন ব্যাংকিং’ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএম গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
স্বাগত বক্তব্যে বিআইবিএমের মহাপরিচালক আব্দুর রহিম বলেন, ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার চর্চার জন্য এ ধরণের মেমোরিয়াল লেকচার কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা শীর্ষক এ মেমোরিয়াল লেকচার ১৯৯৭ সাল থেকে চালু করেছে বিআইবিএম।
প্রসঙ্গত:বিশ্বব্যাংক ভারতের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড.জুনায়েদ কামাল আহমাদ জন্মগতভাবে বাংলাদেশী। এর আগে তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের চীফ অব স্টাফ ছিলেন। ১৯৯১ সালে জুনায়েদ কামাল আহমাদ ইয়াং প্রফেশনাল হিসেবে বিশ্বব্যাংকে যোগদান করেন। তিনি আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপে কাজ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের হয়ে আফ্রিকার অবকাঠামো ইউনিটে তিনি প্রায় ১০ বছর কাজ করেন। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্ত আফ্রিকা অঞ্চলের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বিভাগের পরিচালক ছিলেন। স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাপ্লাইড ইকোনমিকসে পিএইচডি লাভ করেন। এর আগে হার্ভাড ইউনির্ভাসিটি থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ব্রাউন ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন।
মূল প্রবন্ধে ড.জুনায়েদ কামাল আহমাদ বলেন, ব্যাংকিং খাতের নৈতিকতার চর্চা বাড়ানোর জন্য প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। খুব সহজে নৈতিকতার চর্চা চালু করা কঠিন। এজন্য আর্থিক ব্যবস্থায় পাবলিক পলিসি এবং রেগুলেটরী ফ্রেমওয়ার্ক শক্ত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংকের গভর্নিং বোর্ড, ম্যানেজমেন্ট এবং সকল কর্মীদের কর্পোরেট গভর্নেন্স বাস্তবাবায়নে একযোগে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে রেগুলেটরী ফ্রেমওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করতে হবে। যাতে কর্পোরেট গভর্নেন্স বাস্তবায়নে কোন ধরণের গাফিলতি না থাকে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা টেকসই করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। যা ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা বাড়াতেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে সুশীল সমাজের বিশেষ ভূমিকার ওপর জোরারোপ করে তিনি বলেন, আর্থিক ব্যবস্থায় অতিরিক্ত নজরদারী (এডিশনাল ভয়েস) হিসেবে সুশীল সমাজকে কাজ করতে হবে। সুশীল সমাজের এ নজরদারী ব্যাংকিং এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চেকস এবং ব্যালান্স স্থাপনে সহায়ক হবে।
গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারীর সক্ষমতা নিয়মিত বাড়ানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা নজরদারীর ক্ষেত্রে সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি আলাদা বিভাগ কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সহযোগিতায় সব সময়ই ঋণ খেলাপী, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বদ্ধ পরিকর। ব্যাংকিং খাত যাতে আইন কানুনের মধ্যে থেকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয় তার সার্বক্ষণিক তদারকি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তিনি বলেন, কিছু অনিয়মের কারণে অর্জনগুলো মলিন হয়ে যায়। তবে ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের কারণেই শুধু নয়, কিছু ঋণগ্রহণকারীর উচ্চাকাঙ্খাও ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি তৈরি করছে। কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার অনিয়মকারীদের যোগসাজশ এবং প্রভাবশালী খেলাপীর কারণে পুরো অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
ফজলে কবির বলেন, অনৈতিক চর্চাগুলো দীর্ঘ দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আজকের মেমোরিয়াল লেকাচারের মাধ্যমে তরুণ ব্যাংকাররা সততা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং ব্যাংকিং খাতে আরো পেশদারিত্ব দিকে অগ্রসর হবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, এ. এফ.এম. নুরুল মতিন ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ সালে তদানিন্তন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গবেষণা বিভাগে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে তাঁর চাকুরী ঐ ব্যাংকের অপারেশন বিভাগে স্থানান্তরিত হয়। তাঁর দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনে তিনি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে নির্বাহী পরিচালক, ইক্যুইটি পার্টিসিপেশন ফান্ড এর নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর সহ বহু ঊর্দ্বতন পদমর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিআইবিএম এর একজন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। তিনি শুধু একজন দক্ষ কর্মকর্তাই ছিলেন না বরং একজন সম্মানিত ও নিষ্ঠাবান চরিত্রের লোক ছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং পরিকাঠামো নির্মাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন অর্ডার ১৯৭২ প্রনয়ণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সত্তর দশক এবং পরবর্তীতে ব্যাংকিং খাতের উন্নতির জন্য নীতি নির্ধারণী বিষয়ে তাঁর অবদান উচ্চ মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে ব্যাংকিং খাতে তার অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ব্যাংকিং খাতে তাঁর এই অসামান্য অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রসঙ্গত: ড. জুনায়েদ কামাল আহমাদ-এর আগে নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচার প্রদান করেন পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জমান আহমদ,বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহামুদ হাবিবুর রহমান, সিপিডি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড: রেহমান সোবহান, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইদুজ্জামান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিউদ্দিন মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গর্ভনর ড. বিমল জালান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র সাবেক অধ্যাপক মরহুম মুজাফ্ফর আহম্মদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ. বি. মির্জা আজিজুল ইসলাম, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গর্ভনর ড. ইয়েগা ভেনুগোপাল রেড্ডি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সনৎ কুমার সাহা, ভারতের ইনিষ্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ কলকাতার ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. অমিয় কুমার বাগচী, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মহিউদ্দিন আলমগীর, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গর্ভনর ড. ডুভভুরি সুভারাও।