মো. সারওয়ার আলম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন র্যাব সদর দপ্তরে। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৯৬টি অভিযান পরিচালনা করেছেন। ভেজালের দায়ে জেল-জরিমানা করেছেন ৩ হাজার ১১৪ জনকে। চার বছরের ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন তিনি।
খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে সব নিত্যপণ্যই ভেজাল হচ্ছে। এর মধ্যে কোন ধরনের পণ্যে ভেজালের ব্যাপকতা বেশি?
সবচেয়ে বেশি ভেজাল হচ্ছে খাবার ও ওষুধে। ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। একজন মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ছে, তখন কিন্তু সে দেশের অর্থনীতিতে তার ভূমিকাটা রাখতে পারছে না। ৪৫-৫০ বছর বয়সী একজন মানুষ যদি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যায়, তার পক্ষে আর ভালো ভূমিকা রাখা সম্ভব হয় না। এজন্য আমাদের প্রথমেই বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আরো একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে তা হলো, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সুচিকিৎসা যেন পায়। এ দুটি জায়গায় কোনোভাবেই আপস করা যাবে না।
এখন বিষয়টা হচ্ছে, কীভাবে আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন খাবারের যে ভেজাল, সেটা কিন্তু কয়েকভাবে হচ্ছে। প্রথমত, আমাদের অজান্তেই কিছু ভেজাল হয়ে যাচ্ছে। যেমন আমাদের কৃষকরা চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করছেন। সকালে কীটনাশক দিয়ে বিকালেই সেই সবজি তুলে বিক্রি করছেন। তিনি হয়তো জানেনই না যে কীটনাশক প্রয়োগের সাতদিন পর্যন্ত সবজিটা তোলা যাবে না। ফলে যেটা হচ্ছে, কীটনাশকযুক্ত খাবার যখন আমরা গ্রহণ করছি, তখন কিন্তু এগুলো আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে শরীরে ঢুকছে। এ জায়গাটায় আসলে সচেতন করা ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যারা এসবের দায়িত্বে রয়েছেন, উদ্যোগটা তাদেরই নিতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের আরো নিবিড় তদারকি দরকার। আমদানি আদেশে বলা আছে, খাদ্যপণ্য আমদানি করলে সেখানে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা থাকতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছাড়াই প্রচুর পণ্য চলে আসছে। যেকোনোভাবে হোক আমদানিকারকরা এগুলো নিয়ে আসছেন। এক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণে আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো পণ্য যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ব্যাপারেও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। সঠিকভাবে এগুলো হচ্ছে কিনা সেটাও নিবিড়ভাবে তদারক করতে হবে।
খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা স্পর্শকাতর দুটি খাত। এ দুটি খাতকে কীভাবে ভেজালমুক্ত করা যায়?
আমাদের কিছু নীতি তৈরি করতে হবে। যেমন আমাদের এখানে যেকোনো ব্যক্তি চাইলেই রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে পারছেন। চাইলে হাসপাতালও খুলতে পারছেন। উন্নত বিশ্বে কিন্তু রেস্তোরাঁ খুলতে গেলে আপনার একটা ন্যূনতম প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। সেটা এক মাস হোক বা তিন মাস। এ প্রশিক্ষণ নেয়ার ফলে একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী খাবারের মান ও তা সংরক্ষণ প্রক্রিয়াসহ খুঁটিনাটি বিষয় জানতে পারছেন।
নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। জেল-জরিমানাও করছেন। কিন্তু সাজা খেটে পুনরায় একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে ভেজালকারীরা। এ থেকে বেরিয়ে আসার পথ কী?
সাজা খেটে বেরিয়ে এসে অনেকে পুনরায় একই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষকে সবসময় শুধু শাস্তি দিয়ে ভালো করা যায় না। তাকে একটা পদ্ধতির মধ্যে আনতে হবে, যাতে সে এ ধরনের অপরাধে না জড়ায়। এর পরও কেউ পুনরায় একই অপরাধ করলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আমরা যেটা সবসময় চাই, প্রথমবার যখন কেউ অপরাধ করে ফেলে, জেনে হোক বা না জেনে, তাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়। কারণ এসব মানুষের পেছনে একটা পরিবার থাকে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে পরিবারটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য একটা সুযোগ দেয়া হয়। এর পরও কেউ যদি অপরাধ করে, তখন তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প থাকে না। কারণ এটা তখন হয়ে যায় অভ্যাসগত অপরাধ। এ ধরনের অভ্যাসগত অপরাধের শাস্তি অনেক বেশি। সেজন্য আমরা চাই কেউ না বুঝে অপরাধ বা ভেজাল করে ফেললে তাকে একটা সংশোধনের সুযোগ দিতে।
ভেজাল প্রতিরোধে ভোক্তাদের করণীয় কী?
ভোক্তাদেরও সচেতনতার বিষয় আছে। আপনি যখন ফল কিনতে যান, তখন কেন প্রত্যাশা করেন যে ১২টা কলাই একই রকম পাকা থাকবে। তাহলে বিক্রেতা তো চেষ্টা করবেনই আপনাকে সব কলা পাকা দেয়ার। সেটা রাসায়নিক দিয়ে পাকিয়ে হোক বা অন্য কোনোভাবে। এজন্য ক্রেতাকে আগে বুঝতে হবে, সব কলা তো একই রকম পাকা থাকবে না, হলুদও হবে না। এগুলো পর্যায়ক্রমে পাকবে।
সামনে আমের মৌসুম আসছে। মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই যদি আপনি পাকা আম খেতে চান, তাহলে বিক্রেতা তো রাসায়নিক দিয়ে কাঁচা আম পাকানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু ক্রেতা যদি সচেতন হন, তারা যদি মৌসুম আসার আগেই পাকা আম খেতে না চান, তাহলে বিক্রেতাও রাসায়নিক দিয়ে আম পাকিয়ে বাজারে আনবেন না।
ওষুধে ভেজাল কোন প্রক্রিয়ায় হয়?
ওষুধে ভেজাল হয় কয়েকভাবে। প্রথমত, একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আছে, বিশেষ করে মিটফোর্ডকেন্দ্রিক। তারা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ দেশের বাইরে থেকে এনে সেগুলোয় নতুন করে লেবেল লাগিয়ে মেয়াদ বসিয়ে বাজারজাত করে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।
আরেকটা হচ্ছে, আমাদের দেশীয় কোম্পানির জনপ্রিয় ওষুধগুলো নকল করার প্রবণতা। নকলটা হয় কয়েকভাবে। প্রথমত, মোড়কটা একই রকম বানিয়ে সর্বনিম্ন মূল্যের ওষুধ সেখানে রিফিল করে বাজারজাতের মাধ্যমে অধিক মুনাফা করে কেউ কেউ। আরেকটা হচ্ছে, মুভ বা ভিক্সের মতো বিভিন্ন বাম এখানেই তৈরি করে বাজারজাত করা।
রিএজেন্টও কি ভেজাল হচ্ছে?
রিএজেন্টের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ভেজাল হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী চীন থেকে মেয়াদহীন রিএজেন্ট গ্যালন ভরে আনছেন। এখানে এনে সেগুলো প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছেন। আর ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে শর্ট ডেটের রিএজেন্ট আনছে। কারণ রিএজেন্টের মূল্য নির্ধারণ করা হয় তার ডেটের ওপর। শর্ট ডেটের রিএজেন্টের দাম কম। লং ডেটের রিএজেন্টের দাম বেশি। কম দামে শর্ট ডেটের রিএজেন্ট এনে সেগুলোর লেবেল পরিবর্তন করে মেয়াদ বাড়িয়ে ব্যবহার করা হয়। রিএজেন্টের ক্ষেত্রে নিয়ম করতে হবে কোনোভাবেই যেন এক বছরের কম মেয়াদের রিএজেন্টে দেশে না আসে।
ওষুধের ভেজাল রোধে শাস্তি ও মনিটরিং দুটোই বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু তারা দুটি সমস্যায় আক্রান্ত। একটি হচ্ছে অনিয়ম, আরেকটি লোকবল সংকট। সেখানে মিড লেভেলে যারা আছেন, এদের বেশিরভাগই অনিয়মে জড়িত।
আরেকটা সমস্যা হচ্ছে নামি কোনো কোম্পানির ওষুধ নকল হলে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে চায় না। মনে করে, এগুলো জানাজানি হলে তাদের ওষুধের ওপর ক্রেতার আস্থা কমবে। তখন তারা কয়েক গুণ বেশি দামে বাজার থেকে নকল ওষুধগুলো কিনে নেয়। এগুলো না করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই উচিত গোয়েন্দা মনিটরিং বাড়ানো।
আমদানি নীতিমালায় কোনো সংশোধনের প্রয়োজন মনে করেন?
অন্য সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু রাসায়নিকের ক্ষেত্রে আমদানি নীতিমালায় তেমন কিছু বলা নেই। সেজন্যই ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি সেভাবে রাসায়নিক আমদানি করছেন। এজন্য অধিকাংশ ব্যবসায়ীই মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক দিয়ে কাজ করছেন। এ রাসায়নিকই কিন্তু ওষুধ থেকে শুরু করে খাদ্য ও প্রসাধনীতে ব্যবহার হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক শরীরের জন্য নীরব ঘাতকের ভূমিকা পালন করে।
মোটাদাগে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে মূল নিয়ামক কী হতে পারে?
ভেজাল নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কারণ দুর্নীতির সঙ্গে খাদ্য ও ওষুধের ভেজালের বড় একটা সম্পর্ক আছে। প্রত্যেকটি খাতেই ভেজাল প্রতিরোধে যাদের কাজ করার কথা, তারা করছেন না। এর পেছনে আছে দুর্নীতি। যেসব মেয়াদহীন পণ্য বিদেশ থেকে আসছে, সেগুলো তো কাস্টমসেই আটকে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। এসব পণ্য ঠিকই ক্রেতার হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। আবার একজন খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুতের কারখানা করবেন, সে কারখানা পরিদর্শন করে যথার্থতা যাচাইয়ের দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। অনেকসময় ভালোভাবে যাচাই না করেই সনদ ইস্যু করা হচ্ছে। এখানেও দুর্নীতি। তাই বলব, দুর্নীতি কমানো না গেলে ভেজাল কমবে না।
দেশীয় বাজারের ৪০ শতাংশ ইঞ্জিন অয়েলই নকল। এসব ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহারের ফলে গাড়ির ইঞ্জিনগুলো দ্রুত বিকল হয়ে যাচ্ছে। একই ধরনের সমস্যা প্রযুক্তিপণ্যেও, বিশেষ করে সেলফোনে। বাজারে যেসব সেলফোন আছে, তার অর্ধেকই ক্লোনড পণ্য। এসব পণ্য এক বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এতে একদিকে যেমন আমাদের ই-বর্জ্য বাড়ছে, অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছি।
সূত্র: বণিক বার্তা