চলতি বোরো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ৪৪ হাজার হেক্টর জমিরধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়— দমকা হাওয়া, অতি বৃষ্টি, শিলা-বৃষ্টি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বোরোসহ নানা ধরণের ফসল আক্রান্ত হয়েছে।
অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্যমতে— সুনামগঞ্জ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, নওগাঁ, বগুড়া, জয়পুরহাট, কুমিল্লা, নড়াইল, হবিগঞ্জ ও রাজশাহী জেলায় বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে। এসব জেলায় আবাদ হওয়া ৮ লাখ ২৩ হাজার ১৫৩ হেক্টর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪ হাজার ১৬০ হেক্টরের বোরো ধান।
এদিকে, হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বোরো মৌসুমের ধান কাটা শুরু হয়েছে। হাওর এলাকায় এ পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৩ শতাংশ জমির ধান। কৃষকরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়া আরো দীর্ঘস্থায়ী হলে বোরো ধান উত্তোলনে তাদের বেগ পোহাতে হবে।
কৃষি অধিদফতরের তথ্য বলছে— সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমির মধ্যে ৩২ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমির বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে। অন্যান্য জেলার বোরো ধানেরও কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে, সুনামগঞ্জেই আক্রান্তের হার বেশি। ৩১ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
চলতি বছর সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। তবে আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে। সমপরিমাণ জমিতে এবার বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৯৬ লাখ মেট্রিক টন।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের কৃষক মো. মোস্তফা বলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টিতে ধানের বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে ক্ষেতে অতিরিক্ত পানি জমেছে। পানিতে ধানের শীষ ডুবে গেছে। আশঙ্কা প্রকাশ করে ওই কৃষক বলেন, ‘গতবারের চেয়ে এবার ঘরে কম ফসল উঠবে।’
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার কৃষক হিমেল কবীর বলেন, ‘এবার ঝড়-বৃষ্টিতে সব ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ফলন ভালো হলেও বৃষ্টির কারণে এবার ঘরে আলু তুলতে পারিনি। শাক-সবজিও ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে। শিলা-বৃষ্টিতে ধানের শীষও নষ্ট হয়েছে।’
নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে বোরো ধানে চিটা দেখা দিয়েছে। ধানের প্রত্যাশিত ফলন না হওয়ায় কৃষকদের চোখেমুখে এখন হতাশার ছায়া। জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গিউথা হাওর, খুরশিমুল, শিয়াদার, তেঁতুলিয়া, গাগলাজুর, সুয়াইর ও হাঁটনাইয়াসহ বিভিন্ন হাওরে ব্যাপক চিটা দেখা দিয়েছে।
নেত্রকোনার হাওরে চিটা দেখা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, হাওরের প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বশির আহম্মদ সরকার বলেন, ‘বৈরী আবহাওয়ায় কিছু ধান নষ্ট হয়েছে। তারপরও আমরা ধানের ভালো ফলন নিয়ে আশাবাদী। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বোরো ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে।’
শুধু ধান নয়, গত ৩১ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বয়ে যাওয়া ঝড় ও শিলা-বৃষ্টিতে ক্ষতির মুখে পড়েছে গম, ভুট্টা, শাকসবজি, পান, লিচু ও আমসহ বিভিন্ন ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্যমতে— ওই ৯ জেলার ২৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমির মধ্যে ২ হাজার হেক্টর জমির গম নষ্ট হয়েছে। ভুট্টা নষ্ট হয়েছে ৫৩ হেক্টর। ১২ হাজার ৯৪৩ হেক্টরের মধ্যে শাকসবজি নষ্ট হয়েছে ২৯০ হেক্টরের। ৪৭৮ হেক্টরের মধ্যে পান নষ্ট হয়েছে ৭ হেক্টর জমির। ২৮৫ হেক্টরের মধ্যে লিচু নষ্ট হয়েছে ৮ হেক্টরের। আর ওই ৯ জেলার ৫৩ হাজার ৮৮০ হেক্টর আম বাগানের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ হেক্টরের ফসল। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৮ হাজার ২০১ হেক্টরের ফসল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মীর নুরুল আলমবলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টিতে ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তাকে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বলা যাবে না। এখনও বলা যাবে না ফসলের ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় ক্ষয়-ক্ষতি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ঝড়-বৃষ্টিতে ফসল নুয়ে পড়লেও আবার ঠিক হয়ে যেতে পারে। ফলে ফসল নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝড়-বৃষ্টিতে বোরো ধান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ তেমন বেশি নয়।’ তিনি জানান, হাওর অঞ্চলে ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে উৎপাদন কেমন হয়েছে তা আগামী সপ্তাহে জানা যাবে।