বাংলাদেশের পাট প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে ভারত
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৪-১৮ ১০:৩৬:৪১
বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা বহির্বিশ্বে থাকলেও বাস্তবতা হলো বছরের পর বছর দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল কিনে সেটা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিদেশে বিক্রি করছে এবং মুনাফা গড়ছে।
বাংলাদেশের পাটের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি রয়েছে । ফ্রান্সের প্যারিসে ৯ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তৃণা খান। সেখানে স্থানীয়দের নানা ধরনের পাটজাত পণ্য ব্যবহার করতে দেখেছেন। অথচ পাটপণ্য ব্যবহারকারী সেই বিদেশি ক্রেতাদের বেশির ভাগই জানে না এই পাট উৎপাদন হয় বাংলাদেশে।
তৃণা খান বলেন, ‘আমি প্যারিসসহ আশপাশের ছোট শহরগুলোতে মানুষকে পাটের জিনিসপত্র ব্যবহার করতে দেখেছি। এমনকি ফাইভস্টার হোটেলগুলোতেও দেখি আমাদের দেশের পাটের তৈরি কার্পেট। কিন্তু তারা এসব জিনিস কিনেছে ভারত থেকে। কেউ জানেই না যে পাট বাংলাদেশে উৎপাদন হয়।’
বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের নানা ধরনের পণ্য বিশ্বের এমন নানা দেশে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।অথচ সম্ভাবনাময় এই খাতে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকল চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং বিপণনে দক্ষতা না থাকার কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘বাজার ধরার মতো স্ট্রং মার্কেটিং আমাদের নেই, এটা পলিসি লেভেলের ব্যাপার। ভারত আধুনিক মেশিনে পাট প্রসেস করে বিদেশে রপ্তানি করছে। আর আমাদের মেশিন সেই মান্ধাতার আমলের। এ ছাড়া পাটকলগুলোয় দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। আমাদের দক্ষ লোক দরকার। দক্ষ বলতে, টেকনিক্যাল ম্যানপাওয়ার।’ পাটের উৎপাদনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় দেশ হলেও পাটের বর্তমান বিশ্ববাজার দখল করছে ভারত। বাংলাদেশে উৎপাদিত এসব পাটের কাঁচামাল ভারতেই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় এবং বিদেশি ক্রেতারা এই পণ্যগুলো সরাসরি বাংলাদেশ থেকে নয়, বরং ভারতের কাছ থেকে কিনে থাকে। ফলে বাংলাদেশের পাট প্রক্রিয়াজাত করে লাভ গুনছে ভারতের বাজার। প্রধানত বৈদেশিক চাহিদা অনুযায়ী তৈরি পণ্য রপ্তানি সেই সঙ্গে সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে সেটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গের পাট ব্যবসায়ী তপন দাস। তিনি বলেন, ভারত পাট আমদানি করে সেটা নিজেদের মেশিনে প্রসেস করে পণ্য বানিয়ে বিক্রি করে। আর তারা তাদের নিজেদের পুরো বাজারের চাহিদা নিজেরা মেটায়। তার মানে তাদের একটা মার্কেট প্রটেকশনের জায়গা পাচ্ছে।
এ ছাড়া বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দেনদরবার করতে না পারা সেই সঙ্গে সবচেয়ে ভালোমানের পাট রপ্তানি করে দেওয়ার ফলে মানসম্মত পণ্য তৈরি করতে না পারায় বাংলাদেশ তার বাজার তৈরি করতে পারছে না বলে মনে করেন পাট পণ্যের উদ্যোক্তা শাফিয়া সামা। তিনি বলেন, ‘ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দেশগুলোতে কার ইন্ড পাটের বড় একটা বাজার আছে। অথচ বাংলাদেশ সেই বাজারটা দখল করতে পারছে না দুটি কারণে। প্রথমত, ভালো মান নিশ্চিত না করা; দ্বিতীয়ত, দাম নির্ধারণ করতে না পারা। বিদেশি বায়াররা এই দুটি জিনিসই সবার আগে দেখে।’ এ ছাড়া পাট চাষিদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াকেও পাটের বাজার পড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে শাফিয়া সামা মনে করেন।
অন্যদিকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পাটের বাজার পড়ে যাওয়ার পেছনে বিশ্বব্যাংকের একটি কারসাজিকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বিপণন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ। বিশ্বব্যাংকের সেই ফর্মুলায় বাংলাদেশের আদমজী জুটমিল বন্ধ হয়ে যায় এবং সে সময় বাংলাদেশের পুরো বাজার ভারত দখল করে নেয় বলে জানান তিনি। মামুনুর রশিদ বলেন, ‘২০০২ সালের দিকে আদমজী জুটমিল বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলায়। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের লোনে ইন্ডিয়াতে বড় মিল স্থাপিত হয়েছে। এতে ইন্ডিয়া লাভবান হলো, আমাদের সব বায়ার তারাই পেল।’ বর্তমানে বাংলাদেশে পাটের বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখা গেলেও দৃশ্যপট খুব একটা বদলায়নি।