ব্যাংক নিয়ে ‘নয়-ছয়’ করার কারণেই ঋণ ও আমানতের সুদ গড় সুদহার যথাক্রমে ৯ ও ৬ শতাংশে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। আর দেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তাতে সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে আনা সম্ভব হবে না বলেই সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
আমানত হল ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহের মূল উৎস । আমানত সংগ্রহের সুদহারের সঙ্গে ব্যাংক পরিচালন ব্যয় ও মুনাফা যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়। সাধারণ অবস্থায় আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য ৩ শতাংশ হলেই তা ব্যাংকের জন্য লাভজনক। তবে ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, এখন তারল্যসংকটের কারণে তহবিল সংগ্রহের খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয়ও অনেক বেশি। সঙ্গে আছে উচ্চ খেলাপি ঋণ। আবার যত যা-ই ঘটুক, বছর শেষে বড় মুনাফা ঘরে তুলতে হবে। এ কারণে সুদহারে পার্থক্য বেশি রাখা হচ্ছে। আর এ অবস্থায় ব্যাংকের পক্ষে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ঋণের এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় আছে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেও বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখেছে। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বেশির ভাগ ব্যাংকের পক্ষে ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাংকগুলোকে পরিচালন ও মূলধন ব্যয় কমাতে হবে।
ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আমানতে ৬ শতাংশ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় গত বছরের জুনে। এ জন্য ব্যাংকগুলোর করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ হ্রাস করা হয়। আমানত বাড়াতে বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি অর্থ জমা রাখার সীমা ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। আর টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা ও এক পরিবারের ৪ জনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ করে দেয় সরকার। এত সুযোগ-সুবিধা নিয়েও সুদহার কমানো যায়নি। বরং ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় প্রধানমন্ত্রীও গত মাসে ব্যাংক খাতের সমালোচনা করেছেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি, কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক আবুল কাসেম খান বলেন, ব্যাংকগুলো সাড়ে ১১ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে, এতে ঋণের সুদহার আবারও ১৫-১৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আর বাজারে তারল্যসংকট চলছে। ফলে ঋণও সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না।
সুদহার নিয়ে নয়-ছয়
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় তারল্যসংকট গত বছরের শুরু থেকেই। এরপর তারল্য বাড়াতে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বেশি সুদহারে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। এতে আমানতের সুদহার ১১ শতাংশ ও ঋণে ১৫ শতাংশও ছাড়িয়ে গেছে কোনো কোনো ব্যাংকে।
আবার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের চেয়ে ব্যাংকগুলো এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় আমানতের দিকেই আগ্রহ বেশি দেখাচ্ছে। এমনকি গ্রামীণ ব্যাংকও ভালো পরিমাণ তহবিলের জোগান দেয়।
সূত্র জানায়, গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে প্রায় ১১ শতাংশ সুদে আমানত পেতে আবেদন করেছে সোশ্যাল ইসলামী, মার্কেন্টাইল ও এক্সিম ব্যাংক। আরেকটি বড় শিল্প গ্রুপের কাছে আমানত পেতে এনসিসি ব্যাংক ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ১০ দশমিক ১০ শতাংশ ও সাউথইস্ট ব্যাংক ১০ শতাংশ সুদে আমানত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ফারমার্স ব্যাংকের কেলেঙ্কারি ও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিতে না পারায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। তারা সঞ্চয়পত্র ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে ঝুঁকেছে। কেননা সঞ্চয়পত্রে পাওয়া যায় ১১ শতাংশের বেশি হারে মুনাফা এবং তা নিরাপদ। পাশাপাশি ৯ শতাংশ সুদে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ আসছে—এমন খবরে ব্যবসায়ীরাও ঋণ ফেরত দেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এতেও তারল্যসংকট বেড়েছে। আর সংকটেই সুদহার বাড়ছে। আরও আছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, একরকম বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, বড় অঙ্কের টাকা খেলাপিদের কাছে আটকে পড়েছে, চাহিদামতো আমানতও মিলছে না। আবার ৯ শতাংশ সুদে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ আসবে, এমন ঘোষণায় অনেকেই কিস্তি পরিশোধ আপাতত বন্ধ রেখেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্যে বড় চাপ এসেছে।
সবশেষে মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ফারমার্স ব্যাংক ও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিবেশ নষ্ট করেছে, এটা সত্য। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের কারণেও গ্রাহকেরা ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়েছেন।
কীভাবে কমবে সুদহার
কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গবেষণার অংশ হিসেবে প্রতিটি ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়েছিল কিসের ভিত্তিতে তারা সুদহার নির্ধারণ করছে। ব্যাংকগুলো ১৮টি উপাদানের কথা বলেছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে তহবিল সংগ্রহের খরচ। এরপরই আছে চাহিদা-সরবরাহ পরিস্থিতি, সরকারের নীতি, প্রশাসনিক ব্যয়, খেলাপি ঋণ, মূল্যস্ফীতির হার, মুনাফা, ইত্যাদি। সুতরাং সুদহার কমাতে হলে প্রতিটি বিষয়ে নজর দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। না হলে কেবল ঘোষণা দিয়ে বা চাপ দিয়ে সুদহার কমানো যাবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সামগ্রিক বিষয় নিয়ে বলেন, ব্যাংক খাতে অনেক সমস্যা হয়েছে। ফারমার্স ব্যাংক ও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি। খেলাপি ঋণও অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রে সুদহার এখনো অনেক বেশি। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহে। এ কারণে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের পরামর্শ হচ্ছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ প্রদান ও আদায় বন্ধ করতে হবে। আর ঋণ আদায়ে যে আইনি প্রক্রিয়া আছে, তা–ও ত্বরান্বিত করতে হবে। ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দিতে হবে। আর তাহলেই কেবল পরিস্থিতির উন্নতি হবে।