স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছর পরও আমরা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যেমন অভিন্ন পদ্ধতি চালু করতে পারিনি, তেমনি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের বেলায়ও কোনো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতার জন্য সার্বিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি এবং শিক্ষার প্রতি পূর্বাপর সরকারের উদাসীনতাই দায়ী। প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার অকাতরে অর্থ বরাদ্দ করতে পারে, কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বঞ্চনা নিরসনে তাঁদের কার্যকর ও টেকসই কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। শিক্ষার ভিত ঠিক না করে ওপর নিয়ে টানাটানি করলে কোনো লাভ হয় না। শিক্ষা নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন দরকার।
বর্তমানে দেশে তিন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। একশ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সরকারি, যেখানে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণ—সব দায়িত্ব সরকার পালন করে থাকে। আরেক শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো এমপিওভুক্ত, যেখানে শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতন ও কিছু ভাতা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হয়। আর তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি কোষাগার থেকে কোনো অর্থ পান না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় থেকে তঁাদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে যে অর্থ পায়, তা দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণেই সরকারি সহায়তার প্রয়োজন হয়।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২ হাজার ৭৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির জন্য যোগ্য বিবেচনা করেছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীন স্কুল ও কলেজ ১ হাজার ৬২৯টি, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের অধীন মাদ্রাসা ৫৫১টি এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৫৮২টি। এ জন্য সরকারের বাড়তি খরচ হবে ১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর বহু নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হলেও কোনোটি এমপিওভুক্ত করা হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলন করে আসছেন। তাঁদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্তির জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবলকাঠামো ও এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন নেওয়া হয়। আর সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উল্লেখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির জন্য যোগ্য বিবেচনা করেছে।
তাদের এই বিবেচনা নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে পারবে কি না, সেটি নির্ভর করছে অর্থ বরাদ্দের ওপর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা অর্থ চেয়ে ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। অর্থের জোগান হলেই আগামী জুন থেকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করা যাবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, পর্যায়ক্রমে তিন অর্থবছরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করা হবে।
তাঁর কথা হয়তো অযৌক্তিক নয়। গত ৯ বছরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি। ফলে একবারে অনেক বেশিসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার বিষয়টি সামনে এসেছে। কিন্তু শিক্ষকদের দুরবস্থার কথা মাথায় রেখে সরকারের উচিত হবে সমস্যাটি দ্রুততম সময়ে সুরাহা করা। যেখানে বছরে ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট হয়, সেখানে ১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার সংস্থান করা যাবে না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সমস্যাটি যতটা না অর্থের, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে সরকারের অগ্রাধিকারের প্রশ্ন। শিক্ষা খাত সরকারের কাছে কতটা প্রাধান্য পায়, সেটা হচ্ছে আসল কথা। শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ালে দেশ চূড়ান্ত বিচারে কী সুফল পায়, তা সরকারের বিবেচনায় থাকতে হবে।
আমাদের দাবি থাকবে, আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিবেচিত সব যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হোক। সেই সঙ্গে বলা প্রয়োজন যে অতীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি নিয়ে যেসব অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।