ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত শীর্ষ চারটি ব্যাংককে সতর্ক থাকার তাগিদ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অব্যবস্থাপনার কারণে আর কোনো ব্যাংক যেন ফারমার্স ব্যাংকের মতো বিপদে না পড়ে, সেদিকেও বিশেষ নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) পর্যালোচনা বৈঠকে তিনি এসব পরামর্শ দেন।
গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে এ পর্যালোচনা বৈঠকে ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মো. শামস-উল-ইসলাম, জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ, রূপালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর পর্যবেক্ষক মাসুম কামাল ভূঁইয়া, আব্দুর রহিম, আজিজুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম ও রবিউল হাসান উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের এমওইউ পর্যালোচনা বৈঠক হয়েছে। এতে বেশির ভাগ ব্যাংকে বিভিন্ন সূচকের উন্নতি হয়েছে। তবে কম সুদে ঋণ দেয়ায় ব্যাংকগুলোর মুনাফা কম হয়েছে। এছাড়া আমানতে সুদের হার কম থাকায় স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। বৈঠকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এমডিদের আরো সতর্ক থাকার পাশাপাশি আর্থিক বিভিন্ন সূচকে উন্নতি করার জন্য গভর্নর তাগিদ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে এমওইউ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমওইউতে খেলাপি ঋণ আদায়, ঋণ প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা, লোকসানি শাখা ও পরিচালন ব্যয় কমানো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিন মাস পর পর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে এসব লক্ষ্য অর্জনের মূল্যায়ন করা হয়। গতকাল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে এ বৈঠক হয়।
এমওইউ পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ১৮ শতাংশ কমে তা ১২ হাজার ১৮৮ কোটি টাকায় নেমে আসে। একইভাবে ২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে ১৩৭ শতাংশ বেড়ে ১৭ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ২৬ শতাংশ বেড়ে তা ৬ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা ৩ শতাংশ কমে ৪ হাজার ৪২৯ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত এ চার ব্যাংকের তিনটিই প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৮৮ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৫৯৩ কোটি ও রূপালী ব্যাংকের ৮৩৪ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি ছিল। অন্যদিকে এ সময়ে মূলধন
ঘাটতিতে ছিল জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের ৫ হাজার ৮৫৩ কোটি ও অগ্রণী ব্যাংকের ৮৮৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে নগদ আদায় পরিস্থিতিও সন্তোষজনক ছিল না ব্যাংকগুলোর। এ সময়ে সোনালী ব্যাংক ১১৯ কোটি, জনতা ব্যাংক ৯৯ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ১ কোটি ৭৪ লাখ ও রূপালী ৫ কোটি টাকা নগদ আদায় করেছে। অন্যান্য খেলাপির কাছ থেকে সোনালী ব্যাংক ৮৮৮ কোটি, জনতা ব্যাংক ৩৮৪ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৩১৭ কোটি ও রূপালী ব্যাংক ১৮০ কোটি টাকা আদায় করে।
২০১৮ সালে আমানতের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ২৩ শতাংশ ছিল রূপালী ব্যাংকের। এছাড়া অগ্রণীর ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, সোনালীর ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ ও জনতার ৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ আমানত প্রবদ্ধি হয়। অন্যদিকে গত বছর সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ৯১ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় অগ্রণী ব্যাংকের। এছাড়া জনতার ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, রূপালীর ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ ও সোনালীর ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
২০১৮ সালে পরিচালন ব্যয় প্রায় একই (৭৭০ কোটি টাকা) ছিল রূপালী ব্যাংকের। জনতা ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ১০৬ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় ২৮ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। তবে সোনালী ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় প্রায় ৫২ কোটি টাকা কমে হয়েছে ১ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা।