ধান কাটার খরচই উঠছেনা চাষীদের!

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৫-১৩ ১৭:৪১:০৯


দেশজুড়ে চলছে বোরো ধান কাটার উৎসব। নতুন ধান কাটার সময় কৃষকের আনন্দ হওয়ার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও মাথায় হাত পড়েছে তাদের। কারণ ধান কাটতেই যে পরিমাণ খরচ হয়ে যাচ্ছে, ধান বিক্রি করেও তা পুষিয়ে উঠতে পারছেন না তারা।

ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে এককথায় সর্বনাশ হচ্ছে অনেক কৃষকের। প্রতিবাদ হিসেবে নিজের লাগানো ধান ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন টাঙ্গাইলের এক কৃষক। অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন ধান চাষে। বদলে তামাক বা ভুট্টার মতো ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন তারা।

এমনই একজন লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা থানার ভেলাগুড়ি ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল খালেক।

রোববার (১২ মে) ধান কাটতে শুরু করেন আব্দুল খালেক।  তিনি জানান, এক দোন (২৭ শতাংশ) জমির ধান কাটতে চুক্তিতে পরিশোধ করতে হয়েছে ২ হাজার টাকা। সেই এক দোন জমির ধান বাড়িতে আনতে ভ্যান খরচ দিতে হয়েছে ৪০০ টাকা এবং মাড়াই করতে পরিশোধ করতে হয়েছে ৩০০ টাকা।

এর আগে নিড়ানি দিতে খরচ হয়েছে দোন প্রতি ৪০০ টাকা। ধান লাগাতে দিতে হয়েছে দোন প্রতি ১২০০ টাকা, সেচ বাবদ দোন প্রতি ১৬০০ টাকা, সার বাবদ দোন প্রতি ১৫০০ টাকা, বীজ বাবদ ৪০০ টাকা এবং চাষ বাবদ ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে। এক দোন জমির ধান আবাদ করতে সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

বিপরিতে এক দোন জমিতে ধান পাওয়া যায় ১৪ থেকে ১৫ মণ।

আব্দুল খালেক বলেন, বর্তমান বাজারে ধানের দাম (স্থানীয় বাজার দর) সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেই হিসেবে ধানের দাম আসে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। ৯ হাজার টাকা খরচ হলে দোন করা তিন মণ ধান বা ১৫০০ টাকা লোকসান হচ্ছে কৃষকের।

এই কৃষক বলেন, গতবার এই সময় ধানের দাম ছিল ৯০০ টাকা মণ। অথচ এক বছরের ব্যবধানে সেই দাম তো বাড়েইনি, উল্টো কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০ টাকায়। অন্যদিকে গত বছরের তুলনায় ধান কাটার মজুরিও বেড়েছে।

আবেগ তাড়িত হয়ে আব্দুল খালেক বলেন, ‘এভাবে লস করে কার জন্য কেন ধান আবাদ করবো? প্রতি দোন জমিতে তিন মণ ধান লস করছি। নিজের শ্রমের দাম তো বাদই দিলাম না হয়। তাই সামনে আর ধান আবাদ করবো না। পরিবর্তে তামাক আবাদ করবো। তামাক আবাদে অনেক বেশি লাভ। নিজের জন্য এক দোন জমি আবাদ করলেই ছয় মাসের ভাত হয়ে যাবে। বাকী ছয় মাস তো আমন ধানে চলে। তবুও অন্যের জন্য আর ধান আবাদ করব না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতীবান্ধা উপজেলার ভেলাগুড়ি বাজারে ১২/১৩ টাকা কেজিতে ধান বেচাকেনা হলেও একই বাজারে চালের দাম ৩২ টাকা। আর এই চাল রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা।

এমন বৈষম্যের প্রতিবাদে টাঙ্গাইলের এক কৃষক তার ধান ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ধান কাটতে মজুরির পিছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, ধান বিক্রি করে মিলছে তার অর্ধেক। পাওয়া যাচ্ছে না দিনমজুরও। ফলে ধান পেকে মাঠেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে রোববার দুপুরে জেলার কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা গ্রামের আব্দুল মালেক সিকদার তার চাষ করা জমির ধানে আগুন ধরিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এক মণ ধানের দাম ৫০০ টাকা। অথচ একজন দিন মজুরের একদিনের শ্রমের দাম ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। তাও আবার পাওয়া যাচ্ছে না।’

তাই নিজের ধান ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বলে জানান এই কৃষক।

একই ধরনের অবস্থায় পড়েছেন নাটোরের চলনবিল এলাকার কৃষকরা। চলনবিল মানেই মাছ আর ধানে ভরপুর।  বর্ষায় পাবিতে ডুবে থাকে বিল, সেসময় চলনবিলের মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পানি শুকিয়ে গেলে পলি পড়া জমিতে কৃষকরা ধান চাষ করেন। বৈশাখের শুরু থেকেই চলনবিলের ধান কাটা শুরু হয়। সাধারণত এই সময়ে কৃষকের পরিবারের মানুষগুলোর দম ফেলার সময় থাকে না।

তবে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার শ্রীপুর এলাকার কৃষক সাইদুর রহমান  বলেন, ধান লাগানো থেকে শুরু করে কেটে মাড়াই করে ঘরে তোলা পর্যন্ত যে টাকা খরচ হচ্ছে তাতে দান আবাদ করে পোষাচ্ছে না। তাই গত বছর ২০০ বিঘায় (৩৩ শতাংশ) ধান লাগানো হলেও এবার ১০০ বিঘা ধান লাগিয়েছিলেন তিনি। এ বছর ধানের দাম না বাড়লে আগামী বছর আবাদের পরিমাণ আরও কমিয়ে আননবেন। পরিবর্তে ভুট্টা লাগাবেন। জানালেন, দিন মজুর না পাওয়ায় অনেক জমির ধান এখনো কাটা হয়নি।

যদিও লালমনিরহাটের তুলনায় চলনবিলে ধান আবাদ করতে খরচ কিছুটা কম পড়ে। কারণ পলির আবরণ পড়ায় এই জমিতে ধান চাষে সার তেমন লাগে না, আবার ফলনও বেশি হয়। তারপরেও যথাযথ বাজারমূল্য না পেয়ে ধান আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন চলনবিল কেন্দ্রিক কৃষকরা।