কলকাতা বাংলার মিডল রোড চলচ্চিত্র আজ যে প্রশংসনীয় অবস্থানে পৌঁছেছে তা গোটা ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পও পারেনি। শুধু ফেস্টিভাল নির্ভর নয় তাদের চলচ্চিত্র বরং দারুণভাবে কলকাতার থিয়েটারগুলোতেও ব্যবসা করছে। যেসব নির্মাতা আর চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের হাত ধরে মাত্র কয়েক বছরে কলকাতা বাংলা চলচ্চিত্রের অবস্থানটা পরিবর্তন হল, তাদের মধ্যে কবি, অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ সৃজিত মূখার্জি অন্যতম। তরুণ এই মেধাবী নির্মাতা এরই মধ্যে পুরো ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক বিস্ময়! ১৯৭৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এই মেধাবী নির্মাতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
শৈশব জীবন শেষ কলকাতায় শেষ করলেও ডিগ্রী নিতে সৃজিত দিল্লী পাড়ি জমান। প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক পাশও করেন। পরবর্তীতে তিনি জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.ফিল এবং পিএইচডি শেষ করেন। অর্থনীতি ও পরিসংখ্যানে পড়াশোনার পর তিনি দিল্লীতেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চাকরি নেন। সেখানেই থাকতে থাকেন তিনি, কবিতা লিখেন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে মিলেমিশে গান বাজনা করেন। এভাবেই একদিন থিয়েটারের সাথে জড়িয়ে যান। অভিনয় করেন, নির্দেশনা দেন এভাবেই চলতে থাকে।বিভিন্ন জেলায় মঞ্চের কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কখনো বেঙ্গালুরুতে অলিয়স ফ্রঁসেজে, কখনো রাজস্থানে আবার কখনো লখনৌতে। থিয়েটার করতে করতে এভাবেই একদিন সিনেমা বানানোর ইচ্ছায় পেয়ে বসে তাকে। ফলত অর্থনীতিবিদ কিংবা পরিসংখ্যানবিদ হয়ে থাকাটা আর হয়ে উঠে না তার। পশ্চিম বাংলা সিনেমার অন্যতম সিনেমা নির্মাতা ও জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী অঞ্জন দত্তের সাথে সহকারি হিসেবে কাজ করেন। অঞ্জনের সাথে ‘ম্যাডলি বাঙালি’ এবং প্রখ্যাত নির্মাতা অপর্ণার সাথে ‘ইতি মৃণালিণী’তে কাজ করেন সৃজিত। ‘লে ছক্কা’, ‘জোশ’, ‘ক্রস কানেকশন’ ছবির মতো বাণিজ্যিক ছবিতে গানও লিখেন সেসসময়।
কিন্তু ২০১০ সালে এসে নিজের পরিচালনায় সিনেমা বানানোর জন্য উঠে পড়ে লাগেন। এবং সত্যি সত্যিই তিনি নির্মাণ করেন পশ্চিম বাংলার ইতিহাসে এক অন্যতম সিনেমা ‘অটোগ্রাফ’। বিশ্বজয়ী নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘নায়ক’-এর রিমেক করেন তিনি। কিন্তু এতে তরুণ নির্মাতা সৃজিতের স্বকীয়তা আর নিজস্বতা বাংলা ছবিরে ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে থাকে। অসাধারণ সব গান, মাসালা নির্ভর ছবির নায়ক প্রসেনজিতকে দিয়ে এত অসাধারণ অভিনয়ে করিয়ে নেয়ারও জন্যও দারুণ প্রশংসীত হন সৃজিত। নির্মাণ, ক্যামেরার কারিকুরি, অভিনয়, চিত্রনাট্য, ডায়ালগ থ্রোয়িং আর জনপ্রিয়তা পাওয়া সব গান দিয়ে পশ্চিম বাংলা মিডল রোড সিনেমার ইতিহাসে রেকর্ড গড়েন সৃজিত। টানা ১২০ দিন বক্স অফিস দখলে রাখে ‘অটোগ্রাফ’। ছবিটি এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টিরও অধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে।
‘অটোগ্রাফ’ নির্মাণের পর সিনেমায় পা রাখা তরুণ নির্মাতা সৃজিতকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের উপর এরকম বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি প্রথম ছবি দিয়েই পুরো ভারত মাতিয়ে দেন। ফলে সিনেমা নির্মাণকেই একেবারে পেশা হিসেবে নিয়ে নেন সৃজিত। ‘অটোগ্রাফ’-এর ব্যাপক সাফল্য সৃজিতকে এতটা উদ্যোমি করে যে, কালক্ষেপন না করেই ফের সিনেমায় নেমে পড়েন সৃজিত। ঠিক পরের বছরেই সৃজিত নির্মাণ করে ফেলেন আরেকটি অসাধারণ ও ব্যবসাসফল ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’। এ ছবিতেও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে মূল ঘরানার অভিনেতা প্রসেনজিতকেই কাস্ট করেন। যথারীতি সৃজিতের স্পর্শে ফের অন্য মাপের এক অভিনেতা আবিস্কার করেন সকলে। এরপর প্রতি বছরে অন্তত একটি ছবি নির্মাণ করেন সৃজিত। ২০১২ সালে কলকাতার অন্যতম মেধাবী অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিককে দিয়ে নির্মাণ করেন ‘হেমলক সোসাইটি’।
২০১৩ সালে ফের প্রসেনজিতকে দিয়ে গোয়েন্দা গল্প ‘মিশর রহস্য’ নির্মাণ করেন সৃজিত। নিরীক্ষাধর্মী প্রায় সকল ছবিতেই যথারীতি নিজের কারিশমা দেখান সৃজিত।
‘মিশর রহস্য’র পর সৃজিত মূখার্জী নির্মাণ করেন তার ক্যারিয়ারের অন্যতম ছবি ‘জাতিস্মর’। যা ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দিতে সৃজিতকে সহায়তা করে। মোট চারটি ক্যাটাগরিতে ‘জাতিস্মর’ জাতিয় চলচ্চিত্রে পুরস্কার অর্জন করে। এরপর ‘চতুষ্কোন’ এবং ‘নির্বাক’ নামের দুটি ছবি নির্মাণ করেন সৃজিত। ‘চতুষ্কোন’-এর জন্যও সেরা চলচ্চিত্রকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন সৃজিত।
চলতি বছরে অপেক্ষায় আছে সৃজিত মূখার্জির ঐতিহাসিক ছবি ‘রাজকাহিনী’। ট্রেলারের পর এবার প্রকাশিত হল জয়া আহসান অভিনীত পশ্চিম বাংলার মেধাবী নির্মাতা সৃজিত মূখার্জীর ছবি ‘রাজকাহিনী’র প্রথম পোস্টার। জানা গেছে, ক’দিন আগেই সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত ও বাংলাদেশের জয়া আহসান অভিনীত ‘রাজকাহিনী’ ছবির ট্রেলার মুক্তি পেয়েছে, এবার প্রকাশিত হল ছবিটির প্রথম পোস্টার। ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নির্মাতা সৃজিত তার ফেসবুক ওয়ালে আসন্ন ছবি ‘রাজকাহিনী’র প্রথম পোস্টারটি পোস্ট করেন।
’৪৭-এর দেশভাগের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত ছবি ‘রাজকাহিনী’। এরআগে ট্রেলারে নারীদের দ্রোহ আর সংগ্রামকেও দেখিয়েছেন সৃজিত, এবার পোস্টারেও নারীদের সেই দ্রোহই ফুটে উঠেছে।
উল্লেখ্য, আসছে ১৬ অক্টোবর ‘রাজকাহিনী’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশের জয়া আহসান ছাড়াও ছবিটিতে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, শাশ্বত চট্টোপাধ্যয়, প্রিয়াংকা সরকার, কৌশিক সেন, আবির চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, এনা সাহা, ব্রাত্য বসু, কাঞ্চন মল্লিক, সায়নী ঘোষের মত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।