বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। কিন্তু কোনোভাবেই তা এক অঙ্কে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। এ জন্য নতুন উপায় খুঁজছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন খাতে প্রদত্ত গত ১০ বছরের খাতওয়ারি ঋণের সুদ, সুদহারের গতিধারা ও চক্রবৃদ্ধি সুদের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ঋণের সুদহারসহ বেশ কিছু বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ। সেগুলো একত্র করে শিগগিরই প্রতিবেদন আকারে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’
গত ২৮ এপ্রিল ঋণের সুদহারসহ আরো কিছু বিষয়ে তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। চিঠিতে গত ১০ বছরে তফসিলি ব্যাংকগুলো কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন খাতে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার এবং সুদহারের গতিধারা, ব্যাংকগুলো কর্তৃক প্রদত্ত ঋণসমূহে কোন কোন ক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধি সুদ আরোপ করা হয় এবং এই চক্রবৃদ্ধি সুদারোপের কারণ ও যৌক্তিকতা, চক্রবৃদ্ধি সুদের পরিবর্তে সরল সুদারোপ করা হলে তার সুবিধা ও অসুবিধা প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।
ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের কাছ থেকে এরই মধ্যে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামানোর প্রতিশ্রুতি তাঁরা রক্ষা করেননি। বরং বর্তমানে প্রতি মাসেই ঋণের সুদহার বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে অন্তত ২৭টি ব্যাংক তাদের গড় ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের ছয়টি এবং বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ২১টি ব্যাংক রয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি খাতের প্রায় সব ব্যাংকের ঋণের সুদহার দুই অঙ্কের ঘরে। এর মধ্যে বেশ কটি ব্যাংকের সুদহার ১২ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। দু-একটি ব্যাংকের ঋণের সুদহার এখনো ২০ শতাংশের ঘরে। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে ৬ ও ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটা এখন পুরনো ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। সেটা আর বাস্তবায়িত হবে বলে মনে হয় না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণের সুদহার কত হবে সেটি বাজারই নির্ধারণ করবে। ব্যাংক মালিকদের এ ধরনের ঘোষণা দেওয়াটাই ছিল অযৌক্তিক।’ তিনি বলেন, ‘ঋণের সুদহার কমাতে হলে ব্যাংকগুলোর বাহুল্য ও সব ধরনের অহেতুক খরচ কমাতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে হবে।’
১৪ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ পৃথিবীর কোথাও নেই বলে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে মন্তব্য করেন বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গেল ডিজিট সুদহারের যে কথা বলেছিলেন, তা গ্রহণযোগ্য। কারণ সিঙ্গেল ডিজিটের ওপরে হলে যিনি ঋণ নিয়েছেন তিনি শোধ দিতে পারবেন না। আর যারা ঋণ দিয়েছে তারাও ফেরত পাবে না। সারা বিশ্বের সঙ্গে সমন্বিত করে শিগগিরই অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক সুদহার নির্ধারণ করা হবে বলেও ওই দিন সংসদে জানান অর্থমন্ত্রী।
গত ৩১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঋণের সুদহার কেন কমছে না এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে কিছু কিছু ব্যাংক মালিকের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি দেশে শিল্পায়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ব্যাংক ঋণ। আমরা চেষ্টা করছি এটা কমিয়ে আনার। কয়েক দিন আগে আমরা বসেছিলাম কিভাবে ব্যাংকের সুদের হার কমানো যায়। এ জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধাও করে দিলাম। এরপর ব্যাংকে ঠিকই সুদের হার ৯ শতাংশে নামানো হলো। কিন্তু সবাই তা করল না। বাড়াতে বাড়াতে ১৪, ১৫, ১৬-তে নিয়ে গেল।’ তাদের সুযোগ দেওয়ার পরও কেন করল সেই প্রশ্নও রাখেন প্রধানমন্ত্রী।