সভ্যতার সংকটময় পথ বেয়ে নারী আজ সব কাজে পুরুষের সহযোগী। শুধু গৃহস্থালির কাজে নারী নিজেকে ব্যাপৃত রাখেননি। উনিশ শতকে নারীর এ আত্মোন্নয়ন ছিল না। বিশ শতকে রাতারাতি পাল্টে গেছে রক্ষণশীল সে মনোভাব। পরিশীলিত হয়েছে নারীমন। ব্যবহারিক, কারিগরি ও পদ্ধতিগত শিক্ষামনস্কতা তাদের পুরুষ শাসনের বেড়াজালে আটকে রাখতে পারেনি। আঁধার থেকে বেরিয়ে নারী চোখ রেখেছে বহিরাঙ্গনে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কিংবা সাংসারিক সর্বোপরি সব কাজে নারী এখন পুরুষের সঙ্গী। আমাদের দেশে এখন শ্রমিক মজুরির ক্ষেত্রে খুব একটা বৈষম্য চোখে পড়ে না। বাংলাদেশের রফতানির বড় খাত তৈরি পোশাক কারখানায় নারী সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।
উন্নত বিশ্বে নারীর দ্রুত উন্নতি ঘটলেও তৃতীয় বিশ্বে এ পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে বেশ পরে। অশিক্ষার কারণে রক্ষণশীলতা এবং পুরুষের আধিপত্যবাদ ও হীনম্মন্যতা নারীকে ঘরের অন্তঃপুরেই রেখেছে। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এ উপমহাদেশে এমনটির পাশাপাশি নারীর ভূমিকা সেদিনও ছিল একজন রাঁধুনি হিসেবে। নারী মানেই ছিল গৃহের আটপৌরে বস্তু। অবগুণ্ঠিত ও অন্ধকারে ঢেকে রাখা নারী ছিল নিভৃতচারিণী। নারীমনের স্বাধীনতা ছিল না। কেননা নারীর দুপায়ে ছিল অন্নদাতার শৃঙ্খল। দেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক স্ফীত হলেও নারী লাঞ্ছনার হার বেড়েছে।
পুঁজিবাদের প্রথম যুগে কাজের ঘণ্টার কোনো বালাই ছিল না। চৌদ্দ, ষোলো, আঠারো এমনকি বিশ ঘণ্টাও কাজ করতে হতো শ্রমজীবী মানুষকে। সারা দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষরা মুনাফালোভী মালিকদের দ্বারা নির্যাতিত হতো। পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন শ্রমিক স্পাইজ, ফিশার, অ্যাঞ্জেল ও ফিসারের আত্মাহুতী অর্থাৎ ফাঁসির কাষ্ঠে জীবনদানের মাধ্যমে রচনা করে গেছেন বিশ্ব ইতিহাস, যা এখন ঐতিহাসিক মে দিবস হিসেবে পরিচিত। মে দিবসের এ ঘটনা ছিল শ্রমিকের মানবিক মুক্তির সংগ্রাম।
আজকের বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত? এ দেশের শ্রমবাজারে বিশেষ করে নারীর মূল্য কোথায়? দেশে একজন গার্মেন্ট নারী শ্রমিক কি মে দিবসের ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার আদায় করতে পেরেছেন? শ্রমের সময়কালের কথা না হয় বাদই দিলাম। তারা কি পাচ্ছেন তাদের উপযুক্ত মজুরি? কিংবা ন্যূনতম মজুরিটুকুও কি একজন নারী শ্রমিক পাচ্ছেন নিয়মিত? মূল্যস্ফীতির প্রবল জোয়ারে মহানগরে একজন নারী পোশাক শ্রমিক খেয়ে-পরে মাসিক মজুরি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা কি তার স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত?
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এ দেশে পোশাক শিল্প-কারখানা ক্রমে বাড়তে থাকে। নারীর সস্তা শ্রমকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববাজারে চাহিদা এবং নারী শ্রমের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চনার কারণেই তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের প্রবৃদ্ধি বাড়ে। কিন্তু জীবনমান বাড়ে না দেশের নারী শ্রমিকের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সান বিডির সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)