ভলো গ্রাহকদের জন্য সুবিধা রেখে এবং ঋণখেলাপিদের জন্য আরও বড় ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলার অনুযায়ী খেলাপি হওয়া ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ। এমনকি পুনঃতফসিলের আগে সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়া যাবে। অন্যদিকে নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করা গ্রাহকদেরও সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত ৩০ এপ্রিল পাঠানো খসড়া পরিপত্রের আলোকে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক এ সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোতে পাঠিয়েছে। একই দিন আলাদা একটি নির্দেশনার মাধ্যমে ভালো গ্রাহকদেরও সুবিধা দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, বিশেষ এ নীতিমালার আওতায় ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকৃত ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ব্যবসা বা ট্রেডিং খাতের গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি, জাহাজশিল্প এবং লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের কোনো বিশেষ নিরীক্ষা লাগবে না। বিশেষায়িত ব্যাংকের অকৃষি খাতের আমদানি-রফতানিতে সম্পৃক্ত শিল্পঋণও সরাসরি পুনঃতফসিল করা যাবে। তবে এসব খাতের বাইরে অন্য ক্ষেত্রে পুনঃতফসিলের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক বিশেষ নিরীক্ষা করে এমন গ্রাহককে সুবিধা দিতে হবে যিনি প্রকৃত ব্যবসায়ী, যাদের ঋণ নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে মন্দমানে শ্রেণীকৃত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে অবলোপনের বাইরে শ্রেণীকৃত ঋণ রয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দমানে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। আর অবলোপন করা ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকার ঋণও মন্দমানের খেলাপি। এর মানে এ সার্কুলারের আওতায় এক লাখ ১৮ হাজার ৫৬২ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে ব্যাংকগুলো। যদিও সুবিধা নিয়ে ঋণ আদায় কতটা হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে নানান ছাড় দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হলেও খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। বরং সুবিধা নিয়ে ঋণখেলাপিরা কিছুদিন খেলাপি থেকে বিরত থাকার সুযোগ নিয়েছেন মাত্র। এর আগে সুদহার কমিয়ে, ডাউনপেমেন্ট ও মেয়াদের শর্ত শিথিলসহ নানা সুবিধা দিয়ে ২০১৫ সালে ১১টি গ্রুপের ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকার বড় ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। তবে দু'একটি গ্রুপ ছাড়া অধিকাংশই টাকা ফেরত দেয়নি। আর ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে বিশেষ বিবেচনায় ডাউনপেমেন্ট ও মেয়াদের শর্ত শিথিল করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৯৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল করা ঋণের বেশিরভাগই নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে আবার খেলাপি হয়েছে। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে ঋণখেলাপিদের জন্য কঠোর না হয়ে আরও বড় ছাড় দেওয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে।
নানা সমালোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার জারি করা নির্দেশনার শুরুতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিতভাবে পরিশোধ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ঋণ বিরূপমানে শ্রেণীকৃত হওয়ায় ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে উৎপাদনশীল খাতসহ অন্যান্য খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখাসহ বিরূপমানের ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে এসব সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশেষ নীতিমালায় ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাওয়ার জন্য সার্কুলার জারির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহককে ব্যাংকের কাছে আবেদন করতে হবে। ব্যাংকগুলো ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ এবং ব্যাংকের স্থগিত খাতে রক্ষিত সুদের পুরোটা মওকুফ করতে পারবে। তবে কোনো ক্ষেত্রে সুদহার ৯ শতাংশের বেশি হবে না। মাসিক অথবা ত্রৈমাসিক কিস্তিতে এ ঋণ আদায় করা যাবে। প্রচলিত নিয়মে আসল এবং সুদ বিবেচনায় নিয়ে কিস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। ঋণঃতফসিলের ক্ষেত্রে নগদে ন্যূনতম ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিতে হবে। কোনো ঋণের ৯টি মাসিক কিস্তির মধ্যে ৬টি এবং ৩টি ত্রৈমাসিক কিস্তির ২টি অনাদায়ী হলে এ সুবিধা বাতিল হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক থেকে পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সোলেনামার (ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে সমঝোতা) মাধ্যমে চলমান মামলার কার্যক্রম স্থগিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পরবর্তী সময়ে কোনো গ্রাহক শর্ত ভঙ্গ করলে স্থগিত মামলা পুনরুজ্জীবিত হবে। এ সুবিধার আওতায় পুনঃতফসিল সুবিধা নেওয়া ব্যক্তিকে নতুন ঋণসুবিধা দেওয়া যাবে। নতুনভাবে দেওয়া ঋণ যথানিয়মে পরিশোধে ব্যর্থ হলে এ সার্কুলারের আওতায় দেওয়া সব সুবিধা বাতিল হবে।
ভালো গ্রাহকদেরও সুবিধা: খেলাপি গ্রাহকদের পাশাপাশি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করা গ্রাহকদেরও সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে ভালো ঋণগ্রহীতা চিহ্নিত করে তাদের সুদ ফেরত দেওয়ার (রিবেট) মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয। তবে ভালো ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক থেকে সঠিকভাবে এ সুবিধা পাচ্ছেন না। যে কারণে নতুন করে এ নির্দেশনা দেওয়া হলো। কোনো গ্রাহকের ঋণহিসাব ধারাবাহিকভাবে সংশ্লিষ্ট বছরের সেপ্টেম্বর মাস ও তার আগে এক বছর অশ্রেণীকৃত থাকলে এবং মঞ্জুরিপত্র অথবা নবায়নপত্রের শর্তানুসারে ওই গ্রাহকের লেনদেন সন্তোষজনক হলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচিত হবেন। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাস শেষে ভালো গ্রাহক চিহ্নিত করতে হবে। এ ধরনের গ্রাহকের ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত সুদ বা মুনাফার কমপক্ষে ১০ শতাংশ রিবেট বা ফেরত দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে প্রতি বছর গ্রাহক ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত হলে একই রকম সুবিধা অব্যাহত থাকবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, এ ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার আগে ঋণগ্রহীতা থেকে প্রত্যয়ন নিতে হবে যে, তার নিজ নামে বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গত ১২ মাসে বিরূপমানে শ্রেণীকৃত কোনো ঋণ ছিল না এবং বর্তমানেও নেই। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী ভালো গ্রাহকদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। ভালো ঋণগ্রহীতাদের প্রতি বছর ব্যাংক কর্তৃক বিশেষ সনদ দিতে হবে। ব্যাংকের সেরা ১০ জন ভালো ঋণগ্রহীতার ছবিসহ তাদের ব্যবসা সফলতার সংক্ষিপ্ত চিত্র ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করতে হবে। এছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত গ্রাহকদের ছবি, প্রোফাইল ইত্যাদির সমন্বয়ে ব্যাংক কর্তৃক বিশেষ বুকলেট বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো বার্ষিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভালো ঋণগ্রহীতাদের স্বীকৃতি পুরস্কার দিতে হবে।
এককালীন এক্সিট: কেউ চাইলে মন্দমানে শ্রেণীকৃত ঋণ ৩৬০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে পারবেন, যা এককালীন এক্সিট সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে গ্রাহক সুদহারের ক্ষেত্রে আরও সুবিধা পাবেন। এ ধরনের গ্রাহকের সুদ মওকুফ সুবিধার অবশিষ্ট অংশের ওপর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় হারে সুদ প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রেও সোলেনামার ভিত্তিতে ৯০ দিনের মধ্যে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করতে হবে। পরবর্তী সময়ে কোনো গ্রাহক শর্ত ভঙ্গ করলে সুবিধা বাতিল হয়ে মামলা পুনরুজ্জীবিত হবে। ঋণগ্রহীতার আবেদন পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে এক্ষেত্রে ব্যাংককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নির্দেশনার শেষাংশে বলা হয়েছে, বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সুবিধা নেওয়া উভয় ঋণ শ্রেণীকরণের প্রথম পর্যায় তথা এসএমএ মানে শ্রেণীকৃত বিবেচনা করতে হবে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে ১ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হবে। পুনঃতফসিল পাওয়া ঋণ কেন্দ্রীয় ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) 'স্পেশাল আরএসডিএল' এবং এক্সিট সুবিধার ঋণ 'স্পেশাল এক্সিট' হিসেবে রিপোর্ট করতে হবে। এ সুবিধার আওতায় সংশ্লিষ্ট ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ছাড়া আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। এসব ঋণ ব্যাংকগুলোর ঋণ শ্রেণীকরণ বিবরণীতেও শ্রেণীকৃত ঋণ হিসেবে উল্লেখ করতে হবে।