আকাশ, মাটি, আলো, হাওয়া, জল সর্বোপরি প্রকৃতির আবেগ নিয়ে এদেশের মানুষ প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বাংলা গানের ঐতিহ্য প্রবহমাণ রেখেছে। আজো বাংলার আনাচে কানাচে মেঠোপথ ধরে একতারায় আঙুলের স্পন্দন রেখে হেঁটে যায় অনঙ্গ বাউল।
সেই দেশে হঠাৎ করে দুটো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মনে হলো, আমাদের লোকসঙ্গীত হারিয়ে যাচ্ছে, একে সারাবিশ্বে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তারা কি করলেন! নিজের দেশের রাজধানীতে একটা বিশাল আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব আয়োজন করলেন।
সেখানে ডেকে আনলেন আশপাশের দেশ থেকে শিল্পীদের, দেশের মোটামুটি চেনা জানা শিল্পীদের পাশাপাশি রাখা হলো মূলধারার গণমাধ্যমে আলোচিত বিক্রয়যোগ্য শিল্পীদের। সেই অনুষ্ঠান হলো একটি স্টেডিয়ামে। সেখানে বাণিজ্যের পসরা বসালো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানদুটিরও বহুমুখী বাণিজ্য হলো। গানের নামে হলো কর্পোরেটের বিস্তৃত মকারী।
তবে তারা নিজের দেশের আসল সোনা, লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনরেও ফোক বলে চালালেন-মানলাম না হয়, (লালন ও হাসন হইলো ফোক; হা হা হা) কিন্তু কিসের স্বার্থে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন পাশের দেশ থেকে ডেকে আনা যদুমধুকদুকে!? ভাবের জগতে না গেলে হয় না ভাবের গান। লোকগানও ভাবের গান। উনারা রব ফকিরের দলকে সময়ের দোহাই দিয়ে নামায়া দিলেন।
গানের ধরণ, প্রকরণ, প্রকরণের সীমানা, বিশেষ বৈশিষ্ট্যের একটি ধরনের গানে অনেক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করার ক্ষমতা থাকায় তাহারা তারকা সব লোকগানের শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে আনলেন, যাদের অনেকেরই মৌল বৈশিষ্ট্য বা ধ্যানবিন্দু (পড়ুন ফোকাস) হয়তো লোকগান না, কিন্তু লোকগানঘেঁষা মরমিয়া, মর্সিয়া বা আধ্যাত্বিকতার ধরণে পড়ে তাদের গান (তাতে কী মূর্খদের যা খাওয়ানো হয় তাই তো তারা খায়)।
সুতরাং, আবিদা পারভীন ফোক, অর্ণব ফোক, এক্সপেরিমেন্টাল ফোক হইলো জলের গান, কিরণচন্দ্রের গাওয়া রুদ্র'র গান 'ভালো আছি ভালো থেকো' বেসুরো চরম ফোক। আহা সকলি ফোক, সকলি লোক, লোকবাণিজ্য, লোকবলপ্রসারণ।
আহা উৎসব! আহা বাণিজ্য! আহা সংস্কৃতির শক্তির জয়।
অবশ্য, অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে জন্ম নেয়া যেকোন আয়োজনে এমন ভুলভ্রান্তি থাকতে বাধ্য। হে প্রিয় মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস, দয়া করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সাহায্য নেন। আপনাদের বোঝাবুঝিটাকে প্রয়োজনে বুঝদার লোকজন ভাড়া নিয়া শাণিত করেন। আমাদের সমৃদ্ধ লোকগানের ঐতিহ্যের দিকে একবার তাকান।
সংস্কৃতি নিয়ে বাণিজ্য করতে হলে বোঝাবুঝিটা যে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ না, এটা বোঝা গেলো ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট-এ। কিন্তু, সাংস্কৃতিক আয়োজন হিসেবে আমি ফোকফেস্টকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আশা করি পরেরবারের আয়োজনে মাছরাঙা ও সান ইভেন্টস এবারের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠবে। দেশের মানুষকে লোকগান সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়া বন্ধ করবে। জনরুচিতৈরি, সংস্কৃতিসেবাই হবে এই প্রতিষ্ঠানদুটির ব্রত, বাণিজ্য না।লেখক: কবি। সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে কর্মরত; সংস্কৃতি ও বিনোদন বিষয়ক খবরের আয়োজন রঙ্গমঞ্চের ইনচার্জ হিসেবে কাজ করছেন। জন্মদিন ১৭ অক্টোবর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যায়ন বিভাগ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। শিক্ষাজীবনে পালন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট ও আবৃত্তি সংগঠন 'ধ্বনি'র সভাপতির দায়িত্ব। কবিতার বই তিনটি, শিরস্ত্রাণগুলি (২০১০, ঐতিহ্য), সতীনের মোচড় (২০১২, শুদ্ধস্বর) ও কথাচুপকথা…(২০১৪, অ্যাডর্ন বুকস)। ‘কবির কবিতা পাঠ’ অনুষ্ঠানের আয়োজক সংগঠন ‘গালুমগিরি সংঘ’র সমন্বয়ক। বিবাহিত; স্ত্রী ও ছোটভাইকে নিয়ে থাকেন বাংলামোটরে।