নতুনভাবে আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে নওগাঁ। আম উৎপাদনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নাটোর জেলাকে ছাড়িয়ে গেছে। ঠাঠা বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এক ফসলি জমিতে ধান চাষের চেয়ে আম চাষ লাভজনক। যে কারণে প্রতি বছর দুই হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আম বাগান গড়ে উঠছে। এঁটেল মাটির কারণে আম সুস্বাদু হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জেলায় চলতি বছরে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার আম বেচাকেনা হবে। তবে ভরা মৌসুমে আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা ও পাইকারি বাজার গড়ে না তোলায় চাষিরা নায্য মূল্য পান না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্রমতে, এ বছর জেলায় ১৮ হাজার ৫২৭ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। এর মধ্যে পোরশায় ৯ হাজার হেক্টর, সাপাহারে ৪ হাজার হেক্টর, নিয়ামতপুরে ৯৫০ হেক্টর, পত্নীতলায় ২ হাজার ২শ’ হেক্টর, ধামইরহাটে ৬১৫ হেক্টর, মান্দায় ৪শ’ হেক্টর, নওগাঁ সদরে ৪শ’ হেক্টর, মহাদেবপুরে ৩৬০ হেক্টর, বদলগাছীতে ৩৪০ হেক্টর, রানীনগরে ১৪৬ হেক্টর এবং আত্রাইয়ে ১১৬ হেক্টর।
এ বছর আমের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন। নওগাঁর আম সুস্বাদু হওয়ায় গত দু’বছর ধরে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। গত সাত বছর আগে জেলায় মাত্র ৬ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হতো। জেলায় গুটি, ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষিরসাপতি, মোহনভোগ, আশ্বিনা, গোপালভোগ, হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি, বারি-৩, ৪ ও ১১, নাগফজলি, গৌড়মতি উন্নত জাতের আম চাষ হচ্ছে। এ ছাড়াও দেশীয় বিভিন্ন জাতের আম চাষ করা হয়ে থাকে।
জেলার সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার আংশিক বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে খ্যাত। এলাকার জমিতে বছরের একটিমাত্র ফসল বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান। পানি স্বল্পতার কারণে বছরের বেশির ভাগ সময় জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। এছাড়া ধানের আবাদে খরচও বেশি। অপরদিকে আম চাষে লাভ বেশি। ফলে ধান উৎপাদনের খরচ বেশি হওয়ায় কৃষকরা এখন আম চাষে ঝুঁকছেন। এতে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে বাড়ছে আম বাগান। আম্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষিরসাপতি, মল্লিকা, হাঁড়িভাঙ্গা, নাগফজলি ও ল্যাংড়াসহ কয়েক জাতের আম চাষ করা হচ্ছে।
আমচাষিরা বলেন, এ এলাকার আমকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বলে বিক্রি করা হয়ে থাকে। যখন আম পাকা শুরু হয়; তখন একসাথে বাজারে উঠতে শুরু করে। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে আমের দাম কমিয়ে দেয়। এতে চাষিরা দাম কম পায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা লাভ ঠিকই পায়। চাষিরা ন্যায্য দাম পাওনা থেকে বঞ্চিত হন। মৌসুমে আমের দামের ব্যাপারে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন চাষিরা।
আমের বিশেষ জাতের মধ্যে ‘নাগফজলি’ উল্লেখযোগ্য। এটি বিশেষ করে পত্নীতলা, বদলগাছী, ধামইরহাট ও মহাদেবপুরে চাষ হয়ে থাকে। এ আম প্রথমে ১৪-১৫ বছর আগে বদলগাছীতে চাষ শুরু হলেও বর্তমানে পত্নীতলায় বেশি চাষ হয়ে থাকে। অন্য আমের তুলনায় নাগফজলি আম কম পচনশীল, খেতে সুস্বাদু ও বাজারে ব্যাপক চাহিদা। এ আমে ক্ষতিকর ফরমালিন ব্যবহারের প্রয়োজন না হওয়ায় উৎপাদন থেকে বাজারে নিতে খরচও কম হয়। এ আমের বাজার দিন দিন রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
পত্নীতলার নজিপুর মহল্লার ধরনীকান্ত ও শান্ত কুমার বলেন, পত্নীতলায় ১০-১২ বছর আগে কলম পদ্ধতির মাধ্যমে এ আম গাছ তৈরি করা হয়। বিভিন্ন কারণে চাষিরা দিন দিন নাগফজলি আমের চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। ইতোমধ্যে ছোট ছোট আমের বাগান গড়ে উঠেছে। সফল আমচাষিদের কাছ থেকে বাগান তৈরির পরামর্শ নিতে আসেন বিভিন্ন এলাকার চাষিরা।
পত্নীতলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা প্রকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, নাগফজলি আমের গুণাগুণের কারণে কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকেও সহযোগিতা করা হয়। এ কারণে উপজেলায় প্রায় ৬শ’ হেক্টর জমিতে নাগফজলি আম চাষ করা হচ্ছে। আগামীতে এ আম চাষের পরিমাণ বাড়বে।
সাপাহার উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের তছলিম উদ্দীন জানান, তিনি গত বছরের শেষ দিকে ৭ একর জমির উপর আম বাগান গড়ে তুলেছেন। বাগানে প্রায় আড়াই হাজার আম গাছ রয়েছে। এর অধিকাংশ আম্রপালি জাতের। আগামী দুই বছর গাছগুলো থেকে আম সংগ্রহ করা হবে না। পরবর্তীতে আমের উৎপাদন বেড়ে যাবে।
সাপাহার পোস্ট অফিস পাড়ার গোলাপ খন্দকার জানান, প্রতি বছর ২ লাখ টাকা শর্তে ১০ বিঘা জমি ১২ বছরের জন্য ২৪ লাখ টাকা দিয়ে লীজ নিয়েছেন। সে জমিতে বারি-৪ জাতের আম লাগিয়েছেন। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে আম সংগ্রহ শুরু হবে। ১২ বছরে এ জমি থেকে ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার আম বিক্রি হবে।
সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, এ উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান গড়ে উঠেছে। এই আম বাগানে শত শত বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
পোরশা উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের নুরুজ্জামান বলেন, এ অঞ্চলের মাটি এঁটেল হওয়ায় আম খুব সুস্বাদু। পোরশার আম রাজধানীসহ সারাদেশে রফতানি করা হয়ে থাকে। কোন প্রকার রাসায়নিক ছাড়াই আম বাজারজাত করা হয়।
পোরশা উপজেলা আম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুস সামাদ শাহ্ বলেন, আমের ভালো দাম পেতে হলে সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। চলতি বছরে পোরশায় ৬০-৭৫ কোটি টাকার আম বেচাকেনা হবে।
পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজ আলম বলেন, পোরশায় খরা মৌসুমে পানির অভাবে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকে। ইতোমধ্যে উপজেলায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান গড়ে উঠেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক রঞ্জিত কুমার মল্লিক বলেন, জেলায় প্রতি বছর শত শত টন আম উৎপাদন হলেও পাইকারি বাজার না থাকায় কম মূল্যে বিক্রি করে দেন আমচাষিরা। চাষিদের কৃষি বিভাগ থেকে সবসময় পরামর্শ দেওয়ায় চলতি বছর প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়েছে। যেভাবে আম বাগান গড়ে উঠছে তাতে নওগাঁয় আম চাষে বিপ্লব ঘটতে চলেছে।