সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকার প্রস্তাব
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০১৯-০৬-১৬ ১১:২৯:৫৮
দেশের প্রতিবন্ধী সন্তানদের সুরক্ষায় সরকার এবার ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বাড়িয়েছে। আর বেড়েছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তিও।
বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করা প্রান্তিক মানুষের জন্য দুষ্কর। জটিল রোগ হলে তার চিকিৎসা আরো অসম্ভব হয়ে পড়ে। ক্যান্সার, লিভার সিরোসিসের মতো রোগে আক্রান্ত এমন মানুষের সহায়তায় হাত বাড়ানো হয়েছে বাজেটে।
এভাবে প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। কৃষকের জন্য পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা ও সেচের বিদ্যুৎ বিলে ছাড়, সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো ও ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ কর্মসূচির আওতায় প্রান্তিক মানুষের প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ এই প্রণোদনার মধ্যে পড়ছে।
গত বৃহস্পতিবার সংসদে উপস্থাপিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত অন্যবারের চেয়ে আরো শক্তিশালী এবং আওতা বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে ৮৯ লাখ ৬০ হাজার মানুষ ভাতা সুবিধা পাবে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২০ লাখ বেশি। আগের বছর বাজেটে ৬৯ লাখ ১৯ হাজার মানুষ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ভাতা পেয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা বলছেন, সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো ভালো দিক, কিন্তু এ খাতের সুবিধাভোগী বাছাইয়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কারণ অনেক সময় দেখা যায় যে ভাতা পাওয়ার যোগ্য সে পায় না। কাজেই ভাতাভোগী নির্বাচনে স্বচ্ছতা বাড়ানো ও নিশ্চিত করা গেলেই সঠিক উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।
আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে চলতি বছরের চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ৬৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এবার তা ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ আর জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ।
বাজেটে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা চার লাখ বাড়িয়ে ৪৪ লাখ করা হয়েছে। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতভোগী ১৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৪ লাখ, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৫.৪৫ লাখ করা হয়েছে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির পরিমাণ তিনটি স্তরেই—প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে, বেদে ও অনগ্রসর গোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা ৬৪ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৮৪ হাজার; ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগী ভাতাভোগী ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার, চা শ্রমিক ভাতাভোগী ৪০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার, দরিদ্র মায়ের মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগী সাত লাখ থেকে বাড়িয়ে সাত লাখ ৭০ হাজার এবং কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার (স্তন্যদান রত মা) সহায়তা ভাতাভোগী দুই লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ ৭৫ হাজার করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষক ড. নাজনিন আহমেদ বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, কাজের বিনিময়ে অর্থ, নারীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তিসহ বেশ কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ আছে। সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা ভাতাভোগী বাছাইয়ে দুর্নীতি বন্ধ করে সঠিক ব্যক্তিকেই নির্বাচন করতে হবে। শিশুরা যাতে লেখাপড়া বাদ দিয়ে শ্রমে না যায় তার জন্য উপযুক্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরো বেশি বেশি নিতে হবে। যেসব পরিবারে শিশু আছে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।’
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪০.৬২ শতাংশ কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত। ১০ বছরে কৃষি খাতে ৩.৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফসলহানি হলে বা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পেলে কৃষকদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও সরকার কৃষি ভর্তুকি, সার-বীজসহ কৃষি উপকরণে প্রণোদনা ও সহায়তা কার্ড, কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা ও সহজশর্তে ঋণসুবিধা প্রদান করছে।
জানা যায়, প্রতিবেশী ভারতের বাজেটে প্রান্তিক কৃষকের উন্নয়নে নগদ সহায়তা দিচ্ছে সে দেশের সরকার। দুই একরের নিচে জমির কৃষকদের নগদ সহায়তা দেবে ছয় হাজার রুপি। এতে ধারণা করা হচ্ছে, দেশটির ১২ কোটির বেশি প্রান্তিক কৃষক প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে।
নতুন বাজেটে কৃষি খাত ও এ খাতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে নিতে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ও কৃষি ক্ষেত্রে সেচযন্ত্রের ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২০ শতাংশ রিবেট প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা দুই কোটি আট লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন। তবে অভিযোগ রয়েছে, এ ক্ষেত্রে বড় অংশই প্রান্তিক কৃষক নয়, সম্পদশালী কৃষকরাই এ সুবিধা ভোগ করছে। প্রান্তিক কৃষকের উন্নয়নে সরকার প্রণোদনা দিলেও কার্যত সুফল মধ্যস্বত্বভোগী কৃষকের ঘরে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘কৃষি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি খাতে সারের মাধ্যমে সাবসিডি দেওয়া হচ্ছে। এটা ক্ষুদ্র কৃষক ও ধনী কৃষক সবার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু কৃষি খাতে যারা দরিদ্র কৃষক, যারা দুই বিঘা, তিন বিঘা ধান চাষ করে, তাদের খুব দুরবস্থা। তারা ধান চাষ করে, ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না। সে জন্য আমি মনে করি, শুধু দরিদ্র কৃষক নয়, কৃষকদের একটি সীমারেখা করা যেতে পারে, দুই বিঘা পর্যন্ত যারা জমি চাষ করে, তাদের জন্য কিছু নগদ অনুদান দেওয়া যেতে পারে। নগদ অনুদান না দিলে ক্ষুদ্র কৃষকদের দুঃখ কিন্তু কমবে না।’
বাজেট বক্তৃতায় দেখা যায়, স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য দূর করতে জোর দিচ্ছে সরকার। ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পে দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করছে। ২০২০ সালের মধ্যে এক লাখ এক হাজার ৪২টি গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে ৬০ লাখ পরিবার এ সহায়তা পাবে। এ প্রকল্পে এরই মধ্যে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯৫ হাজার ৩৮৬ সমিতির মাধ্যমে দুই কোটির বেশি মানুষ উপকার পেয়েছে।