মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বৈধ সাড়ে ছয় লাখ বাংলাদেশির পাশাপাশি অবৈধ হয়ে পড়া প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি রয়েছে । এই অবৈধ বাংলাদেশিরা এখন গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন। তাঁদের অনেকে রাতে নিজের বাসস্থান ছেড়ে বনে-জঙ্গলেও আশ্রয় নিচ্ছেন।
গত ৯ জুন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, আগামী পাঁচ বছরে মালয়েশিয়া থেকে সব অবৈধ বিদেশিকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাদের ধরতে সমন্বিত অভিযান চালানো হবে। শুধু কারখানা, মার্কেট আর অফিস নয়, বাড়ি বাড়ি অভিযান চালানো হবে।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহিদ্দিন ইয়াসিনকে উদ্ধৃত করে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৪ জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ সাত হাজার ৯০০টি অভিযান চালিয়ে ২৩ হাজার ২৯৫ জন অবৈধ অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছে পাঁচ হাজার ২৭২ জন।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। শুধু অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধেই নয়, তাদের নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। ফলে অবৈধ প্রবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। হাইকমিশনের এই কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বৈধ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার পরও অনেক প্রবাসী তা কাজে লাগায়নি। আবার অনেকে জেনেশুনে অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় আসছে।’
মালয়েশিয়ায় বর্তমানে অবৈধভাবে অবস্থানকারী ১১ জন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তাঁদের দাবি, তাঁরা সবাই মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে দেশটিতে গিয়েছেন। কিন্তু কারখানায় ঠিকমতো বেতন না পাওয়া, দালালদের প্রতারণাসহ নানা জালিয়াতির কারণেই তাঁরা অবৈধ হয়ে পড়েছেন। এমনকি রিহিয়ারিংয়ের (পুনরায় শুনানি) জন্য টাকা জমা দিয়েও বৈধ হতে পারেননি তাঁরা। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের ভয়ে বনে-জঙ্গলে দিন কাটাচ্ছেন।
বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে অবৈধ হয়ে এখন গ্রেপ্তার আতঙ্ক নিয়ে আছেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাইরমারা ইউনিয়নের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী রৌশন আলীর ছেলে মোজাম্মেল হক। তিনি তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ করে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়া যান। ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট এক ফ্লাইটে তাঁর সঙ্গে ৩৭ জন শ্রমিক গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়েই বিপাকে পড়েন সবাই। মালয়েশিয়ার কাজাং শহরের হোমস ফার্নিচার কারখানায় চাকরি নিয়ে গেলেও থাকার জন্য মাসে বেতন থেকে কেটে রাখছিল ৫০ রিঙ্গিত, লেভির জন্য নিচ্ছিল ২০০ করে। কোনো ওভারটাইম হচ্ছিল না। মাসে মাসে এক হাজার রিঙ্গিত থেকে এভাবে ২৫০ রিঙ্গিত কেটে নিয়ে যায় ছয় মাস। কম্পানির এমন অনিয়ম দেখে একসময় ৩৭ জনই পালিয়ে অবৈধ হয়ে পড়েন।
মোজাম্মেল বলেন, ‘আমি এখন দিনের বেলায় বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে কাজ করি আর রাতে বনে-জঙ্গলে অবস্থান করি। পরিস্থিতি এখন খুবই খারাপ, দেশেই ফেরত আসতে হবে।’
অবৈধ অভিবাসী নরসিংদীর রায়পুরার বিল্লাল হোসেন, শামীম হোসেন, মিরাজুল ইসলাম জানান, দিনের বেলায় বিভিন্ন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও রাতের বেলায় বনে-জঙ্গলে গিয়ে কোনোমতে রাত কাটান। তাঁরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন গ্রেপ্তার হলেই ভয়ংকর নির্যাতন সইতে হবে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, অবৈধ হলেও কয়েক বছর আগে পুলিশের উৎপাত ছাড়াই গ্রামে এবং পাহাড়ি এলাকায় বসবাস ও উপার্জন করা যেত। কিন্তু ইমিগ্রেশন পুলিশ এখন অবৈধদের ধরতে প্রতিটি শহরের কারখানা, কম্পানি, মার্কেটসহ জনবহুল এলাকায় প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে।
অবৈধ অভিবাসীরা জানান, মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ অবৈধদের আটক করার পর ভয়ংকর নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের ভয়ে অনেকেই দেশে ফিরতে চাচ্ছেন। কিন্তু পারছেন না। কারণ ট্রাভেল পাস বন্ধ। তাঁদের দাবি, মালয়েশিয়া সরকার যেন ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে অবৈধ অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার সুযোগ যেন দেয়। কিংবা আবারও রিহেয়ারিংয়ের সুযোগ দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেয়।
প্রবাসীদের অভিযোগ, রিক্রুটিং এজেন্সি এবং মালয়েশিয়ার একটি সিন্ডিকেট চায় না অবৈধ অভিবাসীরা বৈধ হোক। অবৈধদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে নতুন করে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনতে চায় তারা। এর মাধ্যমে নতুন করে জনপ্রতি সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকায় আয়ের হাতছানি রয়েছে তাদের সামনে। ওই সিন্ডিকেট মনে করছে, অবৈধ শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় বৈধ হয়ে গেলে নিরাপদে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করার সুযোগ পাবে। এতে বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি শ্রমিক নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ দেশে অর্ধেক অভিবাসী জালিয়াতি আর প্রতারণার শিকার হয়ে অবৈধ হয়ে আছেন। এদের বৈধ করার ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের জোরালোভাবে আলাপ-আলোচনা করা উচিত।’