যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, ভারতের মতো বাংলাদেশের মানুষও সাবওয়ে বা পাতাল রেলে চলাচলের সুযোগ পেতে যাচ্ছে। মেট্রো রেল লাইন-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর এলাকা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে মাটির নিচ দিয়ে। অন্যদিকে মেট্রো রেল লাইন-৫ এর আওতায় সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার হবে পাতাল রেল।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিটের (এমআরটি) এই দুই প্রকল্পের আওতায় মোট ৩৩ কিলোমিটার নির্মাণ হবে সাবওয়ে বা পাতাল রেল। বাকিটা হবে উড়াল পথে। হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত মেট্রো রেল করতে গিয়ে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে ফেলা হবে। সাময়িক সময়ের জন্য বর্তমান স্থান থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার (বিএডিসি) ৩০ একর জায়গা বাসস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হবে। বাস মালিক সমিতি এরই মধ্যে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে।
২০২৭ সালের মধ্যে দুটি মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ডিএমটিসিএল। এর কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার তীব্র যানজটের পাশাপাশি শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে আরো দুটি মেট্রো রেল পথ নির্মাণের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। মেট্রো রেল লাইন-১ ও মেট্রো রেল লাইন-৫ নামের এই প্রকল্প দুটি অনুমোদনের প্রক্রিয়ার জন্য গত সপ্তাহে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ৯৩ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন ও ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা আশা করছেন, আগস্টের মধ্যেই প্রকল্প দুটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হবে। এর পরই শুরু হবে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া।
প্রসঙ্গত, উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলমান ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রো রেল লাইন-৬ প্রকল্পের কাজ চলছে জোরেশোরে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালের বিজয় দিবসে এই মেট্রো রেল যাত্রী চলাচলের জন্য উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানতে চাইলে এমআরটি-১ প্রকল্পের পরিচালক সাঈদুল হক বলেন, ‘আমরা দুটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। আশা করছি, শিগগিরই প্রকল্প দুটি একনেক সভায় অনুমোদন পাবে। এরপর আমরা মূল কাজ শুরু করব।’ তিনি বলেন, মেট্রো রেল প্রকল্প দুটির কাজ একসঙ্গে চললে মানুষের ভোগান্তি তেমন হবে না। কারণ এই দুটি মেট্রো রেলের বেশির ভাগ কাজই হবে মাটির নিচে।
প্রকল্প দুটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রো রেল লাইন-১ এর দৈর্ঘ্য ৩১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৯ কিলোমিটার হবে সাবওয়ে বা মাটির নিচ দিয়ে। বাকি ১২ কিলোমিটার হবে এলিভেটেড বা মাটির ওপর দিয়ে। এই রুটে মোট স্টেশন থাকবে ১৯টি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ৫১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ঋণ মিলবে ৩৩ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। বাকি ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে। বিমানবন্দর-কমলাপুর প্রকল্পে রুট থাকবে দুটি। একটি হবে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। আরেকটি নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত। বিমানবন্দর রুটটি সরাসরি কমলাপুর চলে যাবে। আর পূর্বাচল রুটটি নতুন বাজার থেকে পূর্বাচলে যাবে।
প্রকল্প প্রস্তাবে দেখা গেছে, মেট্রো রেল লাইন-১ রুটটি বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনাল দিয়ে খিলক্ষেত হয়ে যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা গেট দিয়ে নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ হয়ে কমলাপুর গিয়ে শেষ হবে। এর আরেকটি রুট যাবে নতুন বাজার থেকে পূর্বাচলের দিকে। এই রুটে ঘণ্টায় ৬৬ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে।
ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, বর্তমানে সড়ক পথে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরে যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। এই পথ মেট্রো রেলে পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ২৪ মিনিট। আর কমলাপুর থেকে পূর্বাচলে মেট্রো রেলে যেতে সময় লাগবে ৩৬ মিনিট। এতে ঢাকার নাগরিকদের অনেক সময় বেঁচে যাবে।
অন্যদিকে মেট্রো রেল লাইন-৫ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ দেবে ৩০ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে ১০ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। ২০২৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ডিএমটিসিএল। এ রুটের দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে সেনানিবাস হয়ে ভাটারায় গিয়ে প্রকল্পটি শেষ হবে। ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার হবে পাতাল রেল। বাকি ছয় কিলোমিটার এলিভেটেড বা উড়াল পথ। এখানে থাকবে ১৪টি স্টেশন। ৯টি থাকবে মাটির নিচে। আর পাঁচটি থাকবে ওপরে। হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে বালিয়ারপুর, মধুমতি, আমিন বাজার, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২, নতুন বাজার হয়ে ভাটারায় গিয়ে শেষ হবে।
প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করতে, অর্থাৎ পাতাল করতে গিয়ে এত মাটি কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। বেশ কয়েকটি ডেভেলপার কম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলার কথা বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া বহুতল ভবনের নিচ দিয়ে কিভাবে লাইন নেওয়া হবে সেটি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এ বিষয়ে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে।
ডিএমটিসিএলের অতিরিক্ত সচিব হারুনুর রশীদ বলেন, ‘মেট্রো রেল-১ ও ৫ প্রকল্প দুটি আমরা এক সঙ্গে শুরু করতে চাই। আগস্টের মধ্যে প্রকল্প দুটির অনুমোদন পেলে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আন্তর্জাতিকভাবে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করতে এক বছর লাগবে। এরপর বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার লাইন সরাতে আরো এক বছর সময় লাগবে। ওই সময়ের মধ্যে চলমান মেট্রো রেল-৬ প্রকল্পটি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে উদ্বোধন হয়ে যাবে। এতে ঢাকার বাসিন্দাদের চলাচল পথের চাপ কমবে। তখন প্রস্তাবিত দুটি প্রকল্পের বড় কাজটি শুরু হবে মাটির নিচ দিয়ে। এতে নাগরিকদের তেমন অসুবিধায় পড়তে হবে না।