মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা যখন বাংলাদেশের কাঁধে তখন কাছের বন্ধু ও পরাশক্তি চীন কার্যত নীরব, নিষ্ক্রিয়। রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে চীন কার্যত দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ও আলোচনার ওপর জোর দিচ্ছে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যা সমাধান করতে চায় বাংলাদেশও। তবে মিয়ানমার যাতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি মেনে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করে সে জন্য বন্ধু চীনের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ।
সফর প্রস্তুতি-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ১ থেকে ৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে ছয়-সাতটি চুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এই সফরে চুক্তির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ইস্যু। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার ঢল নামার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটিই প্রথম চীন সফর। আর এ সফরে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি খোয়াছিয়াংয়ের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের যে ভূমিকা বাংলাদেশ চেয়েছিল তা এখনো পায়নি। পশ্চিমা বিশ্ব রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টি ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে চীনকে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব যে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল সে অনুযায়ী বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে নতুন করে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর সহযোগিতা চাইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চীনের দিক থেকে সে সময় তেমন সাড়া মেলেনি। এ বছর আরো আগের দিকে প্রধানমন্ত্রীর সফরের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত দুই দেশের জন্য সুবিধাজনক সময় মেলেনি। অবশেষে এবার যে সফর হচ্ছে তাতে প্রধানমন্ত্রী অন্তত রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের বিপদ ও দুর্ভাবনার কথা সরাসরি চীনকে জানানোর এবং এ নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অতি দ্রুত ফেরত পাঠানো না গেলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও বারবার এ বিষয়ে বিদেশিদের সতর্ক করেছেন। বিশেষ করে চীন প্রসঙ্গেও তিনি বলেছেন যে রোহিঙ্গারা না ফিরলে এর প্রভাব চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পড়তে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্ট্র্যাটেজিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, চীন চাইলেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় অগ্রগতি প্রত্যাশা করে বলেছেন, ‘মিয়ানমার যেহেতু চীনকে শ্রদ্ধা ও পছন্দ করে, আমাদের ধারণা, চীন যদি বলে তাহলে মিয়ানমার ত্বরিত গতিতে এই প্রত্যাবর্তন ব্যবস্থা শুরু করতে পারে। রাষ্ট্রদূত ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনায় চীন আমাদের যে ধরনের ধারণা দিচ্ছে তা হলো তারা আমাদের সঙ্গে একমত। বাস্তুচ্যুত লোকজন ফিরে যাক তা তারাও চায়। আমরা আশাবাদী।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের অবস্থান মূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আমাদের দিক থেকে সর্বোত্তম চেষ্টা হিসেবে মনে করা যেতে পারে। সেদিক থেকে আমরা আশা করতে পারি।’
তিনি বলেন, চীন ইচ্ছা করলেই বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে। চীনারা তো এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা শুরু করেছিল। প্রত্যাবাসন চুক্তি সই হওয়ার আগে চীন সক্রিয় ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে চীনকে এ ইস্যুতে আরো সক্রিয় করা যায় কি না তাই দেখা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—দুই দেশের সঙ্গেই নিরাপত্তা পরিষদে ‘ভেটো’ ক্ষমতাসম্পন্ন চীনের বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। এখন যদি এই দুই দেশের (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) মধ্যে সমস্যাটা থেকে যায় এবং চীন যদি কিছুই না করে তাহলে একটা সময়ে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহের অভাব দেখা দেবে। অন্যদিকে চীন যদি সমাধানের দিকে যায় তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গেও আরো বড় ধরনের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—চীনের স্বার্থেই এ সমস্যার সমাধান হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—দুই দেশেই বড় বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন এবং এই দুই দেশই চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই)’ আছে। চীনই এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) চেয়ারম্যান মুনশি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট অত্যন্ত জটিল। এ সংকটের কারণে চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পরীক্ষার মধ্যে পড়বে তা আমি মনে করি না। আমরা যেভাবে চাচ্ছি ভারত তো সেভাবে কথাবার্তা বলছে না। তাহলে তো ভারতের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক পরীক্ষায় পড়তে পারে। ওই দেশগুলোকে দূরে সরানো নয়, বরং হাতে রেখে কিভাবে লাভজনক হয় সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চীন ইতিমধ্যে যেভাবে সম্পৃক্ত আছে অন্য কেউ সেভাবে সম্পৃক্ত হয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যাতে আলাপ-আলোচনা হয় সে ব্যাপারে চীন মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা ঠিক যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে করেনি এখনো।’
মুনশি ফয়েজ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও চীন ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমারকে তো কেউ বিশ্বাস করবে না। সে ক্ষেত্রে চীনসহ কিছু রাষ্ট্র নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে। বাংলাদেশের ওপর চাপ কমাতে মিয়ানমারের ভেতর রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ মেয়াদে থাকার ব্যবস্থা ও নজরদারি করার ক্ষেত্রেও চীন ভূমিকা রাখতে পারে। এই সংকট জিইয়ে রেখে চীন, মিয়ানমার কারো জন্যই লাভ হবে না—এ বিষয়ে চীনকে বোঝানো প্রয়োজন।