একসময় দেশের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল বেসিক, ইসলামী ও জনতা ব্যাংক। তবে এখন তিনটির অবস্থাই খারাপের দিকে। গৌরবের বেসিক ব্যাংক তার গৌরব হারিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। জনতার জনপ্রিয়তা কমেছে, বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ইসলামী ব্যাংকও হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতে, এই তিন ব্যাংকের নাজুক অবস্থা পুরো ব্যাংক খাতের জন্যই উদ্বেগের কারণ। তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাংকে একসময় সুশাসন ছিল। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদে বাজে লোকদের বসানোর কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে।’ এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘একজন বাজে লোককে চেয়ারম্যান করার খেসারত দিচ্ছে বেসিক ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা বদলে যারা চালানোর দায়িত্ব নিলেন, তারাও ভালো করতে পারছেন না। আর সুশাসন না থাকায় জনতা ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে।’
বেসিক ব্যাংক
২০০৯ সালের আগে সরকারি খাতে ‘মডেল ব্যাংক’ মনে করা হতো এটিকে। তখন প্রতিবছর মুনাফা বেশি করায় ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও ছিল অন্য ব্যাংকের চেয়ে বেশি। এর খেলাপি ঋণ ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন ভয়ানক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা ব্যাংকটিকে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জোগান দিয়েছে সরকার। এরপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। মূলধন ঘাটতি পূরণে আরও ৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে তারা। ব্যাংকটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে লেখা এক চিঠিতে এই টাকা চাওয়া হয়েছে।
খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকে একসময় সুশাসন ছিল। কিন্তু শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকটাকে নষ্ট করা হলো। তিনি যখন ব্যাংকটিকে ধ্বংস করতে লাগলেন, তখনও যদি তাকে সরিয়ে দেওয়া হতো, তাহলেও ব্যাংকটি বেঁচে যেতো। বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে সরানোর জন্য চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু অনেক পরে তাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সুযোগ করে দেওয়া হলো।’
২০০৯ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে সরকার সমর্থক ব্যক্তিদের বসানোর পর এটিতে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে থাকে। ২০১১ সাল থেকে মডেল ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সহায়তায় ব্যাংকটি থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়। অথচ চার বছর পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। প্রথমে ২০১৪ সালের মার্চে বেসিক ব্যাংকের এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে শোকজ করা হয়। পরে ওই বছরের ২৯ এপ্রিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই বছরের ২৫ মে এমডি কাজী ফখরুলকে অপসারণ করা হয়। পরে বিতর্কিত চেয়ারম্যান বাচ্চু স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
জনতা ব্যাংক
২০১১ সালের দিকে যখন সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়, তখনও রাষ্ট্রায়ত্ত জনতার অবস্থা অনেক ভালো ছিল। অথচ এখন এটি চলছে ধার-দেনা করে। সব সূচকে পিছিয়ে পড়েছে ব্যাংকটি। একদিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে পরিচালন ব্যয়। ব্যাংকটি একবছরে নিট লোকসান করেছে ছয় হাজার ৬৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের শুরুতে পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এখন শুধু জনতা ব্যাংকেই তা ২১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুই বছর আগেও জনতার পরিস্থিতি বেশ ভালো ছিল। ২০১৭ সালে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা।
খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, ব্যাংকটির খেলাপি বেড়ে যাওয়ার পেছনে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলা বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সরকার খেলাপিদেরই বেশি পছন্দ করে। খেলাপিদের মদত দেওয়ার কারণেই খেলাপির পরিমাণ বেড়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘যাদের কারণে খারাপ লোকজন ঋণ পেলো, তাদের যদি শাস্তি হতো, তাহলে ব্যাংকটি এত খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তো না।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জনতা এখন ডুবতে বসেছে। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, টাকা ধার করে ও মূলধন ভেঙে দৈনন্দিন কাজ চালাতে হচ্ছে। এতে বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে তারা। এ পরিস্থিতিতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন অর্থ মন্ত্রণালয়। ঋণখেলাপির সংখ্যা ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে ব্যাংকটিকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক সভায় জনতাসহ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া সাত ব্যাংকের এমডিকে তলব করা হয়।
জানা গেছে, অ্যাননটেক্স গ্রুপ ও ক্রিসেন্ট গ্রুপকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ দিয়েছে ব্যাংকটি। সম্প্রতি অ্যাননটেক্স গ্রুপের প্রায় ছয় হাজার কোটি এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জনতার চেয়ারম্যান থাকার সময় ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্সকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়। সেই ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে পরে আরও কয়েকগুণ টাকা হাতিয়ে নেয় গ্রুপ দুটি। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. বারকাত।
ইসলামী ব্যাংক
বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকও ভালো নেই। একসময় ব্যাংকটি দেশের বিপদে পড়া অন্য ব্যাংককে আর্থিকভাবে সহায়তা করতো। এখন নিজেই সংকটে। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত সংকটের শুরু ২০১৬ সাল থেকে। ওই বছরের মাঝামাঝিতে ব্যাংকটির মালিকানায় পরিবর্তন আসে। এরপর থেকে বিভিন্ন সূচকে অবনতি হতে থাকে এটির।
তথ্য বলছে, তহবিল সংকটের কারণে ব্যাংকটি আগের মতো ঋণ দিতে পারছে না। বিতরণ করা ঋণও ঠিকঠাক ফেরত আসছে না। ফলে খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এখন ইসলামী ব্যাংকের। গত তিন মাসে ব্যাংকটিতে খেলাপি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গত মার্চের শেষে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮.৮৩ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষে তা ছিল ২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের এই পরিস্থিতির জন্য পেশাদারিত্বের অভাবকে দায়ী করেন খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, ‘মালিকানা পরিবর্তন হওয়ায় ব্যাংকটির পেশাদারিত্বের অভাব লক্ষ করা গেছে।’
প্রসঙ্গত, বেসরকারি খাতের সবচেয়ে লাভজনক হিসেবে ভূমিকা রাখা ইসলামী ব্যাংকে একদিকে পরিবর্তন হয়েছে মালিকানার, অন্যদিকে পরিবর্তন এসেছে ব্যবস্থাপনাতেও। আগে জামায়াত ঘরানার ব্যক্তিরা এটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন তা চলে গেছে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলমের হাতে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে প্রথমে জামায়াত ঘরানার ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি আরও বড় পরিবর্তন আসে এ ব্যাংকে। ওই দিন ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক রদবদলসহ পুনর্গঠন করা হয় পরিচালনা পর্ষদ। পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে সরিয়ে নতুন চেয়ারম্যান করা হয় সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে। পদত্যাগে বাধ্য করা হয় তৎকালীন এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে।
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। শুরু থেকেই ব্যাংকটির ওপর জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপক প্রভাব ছিল।